উদ্বেধী আগ্নেয়চ্ছ্বাসের ফলে গঠিত ভূমিরূপ সমূহ (Landforms associated with Intrusive Volcanicity)
উদ্বেধী আগ্নেয়চ্ছ্বাসের ফলে গঠিত ভূমিরূপ সমূহ (Landforms associated with Intrusive Volcanicity) :
অনেক সময় ভূ-গর্ভস্থ ম্যাগমা ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছাতে না পেরে ভূ-ত্বকের ফাটলের মধ্যে জমাট বেধে নানারকম ভূমিরূপ গঠন করে। এই ধরনের ভূমিরূপকে উদ্বেদী আগ্নেয়চ্ছ্বাসের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ বলে। এই জাতীয় ভূমিরূপ গম্বুজের ন্যায় সমান্তরাল পাতের ন্যায়, বা লেন্সের ন্যায় হয়ে থাকে। এই ধরনের ভূমিরূপগুলিকে উদ্বেদী আগ্নেয় উদ্ভেদ (Intrusive Volcanic Out Crop) বলে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষয়কার্যের ফলে ভূঅভ্যন্তরস্থ আগ্নেয় উদ্ভেদগুলো ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই জাতীয় ভূমিরূপগুলি হল—
a) ডাইক (Dyke) :
ভূ-ত্বকের মধ্যে ম্যাগমা শিলাস্তরের অসমান্তরালে ঊর্থাৎ উল্লম্বভাবে ফাটলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে যে সরু পাতের উদ্বেদী অবয়ব বা ভূমিরূপ গঠন করে তাকে ডাইক বলে। এটি উল্লম্ব বা তীর্যকভাবে অবস্থান করে, এটি 1-10 মিটার চওড়া হয়, ডাইক যদি ক্ষয় প্রতিরোধী হয় তবে শৈলশিরাও দুর্বল হলে ভূপৃষ্ঠে দীর্ঘ খাত গঠন করে। উত্তর-পশ্চিম স্ক্যান্ডের বিশেষত মাল্ (Mull) ও অ্যারন (Arran) দ্বীপে শত শত ডাইক দেখা যায়। ভারতে ছোটোনাগপুর ও দাক্ষিণাত্যের মালভূমির স্থানে স্থানে ডাইক দেখা যায়।
b) সিল (Sill):
পাললিক শিলাস্তর বা অন্য কোনো গঠনতলের সমান্তরালে অবস্থিত চাদরের মতো আগ্নেয় উদ্ভেদকে সিল বলে। এটি শিলাস্তরের সাথে অনুভূমিকভাবে অবস্থান করে। 2-3 সেমি. পুরু হয়, তবে কখনো তা 900 মিটার পুরু হয়। নগ্নীভবনের ফলে এর উপরিভাগ ধাপযুক্ত হয় ও খাড়া ঢাল দেখা যায়। সমতল চ্যাপ্টা মালভূমির সৃষ্টি করে। উত্তর নর্ধাম্বারল্যান্ডের উপকূলে প্রায় 150 বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে সিল অঞ্চল দেখা যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো মালভূমিতে সিল ভূমিরূপ দেখা যায়। গ্রেট ব্রিটেনের ‘গ্রেট হুইনসিল’ পৃথিবী বিখ্যাত। এর বিস্তার 4000 বর্গ কিলোমিটার। ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে ও রাণিগঞ্জ ঝরিয়ার কয়লাক্ষেত্রে সিলের অবস্থান দেখা যায়।
c) ব্যাথোলিথ (Batholith):
ভূপৃষ্ঠের নীচে বৃহদাকৃতির যে উদ্বেদী আগ্নেয়শিলা দেখতে পাওয়া যায়, তাকে ব্যাথোলিথ বলে। Batholith ইংরেজি শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Bathos’ থেকে এসেছে, যার ইংরেজি অর্থ (Deep rock) বলে। ব্যাথোলিথ আয়তনে বিশাল হয় এবং এর পার্শ্বদেশ খুব খাড়াইভাবে ভূগর্ভে নেমে যায়। ব্যাথোলিথের মূল বা পাদদেশ এত গভীরে থাকে যে দেখা যায় না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উটা প্রদেশের হেনরি পর্বত একটি ব্যাথোলিথের উদাহরণ। আমেরিকার হেনরী পর্বত ও আয়ারল্যান্ডের উইকলো পর্বত ব্যাথোলিথের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ব্যাথোলিপ সবথেকে বড়ো। এর প্রস্থ 50 কিমি. ও বিস্তার 2400 কিমি.।
d) ফ্যাকোলিথ (Faccolith) :
ভাজযুক্ত শিলাস্তরের ঊর্ধ্বভঙ্গের চূড়ার (Saddles of Anticlines) কিংবা অবতল ভঙ্গের তলার (Keels of Syncline) শিলাস্তর দুর্বল হওয়ায় সেখানে ম্যাগমা অনুপ্রবেশ করে জমাট বেঁধে লেন্সের মতো যে ভূমিরূপ গঠন করে, তাকে ফ্যাকোলিথ বলে। এশিয়ার হিমালয় ও ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে ফ্যাকোলিথের অবস্থান শোরপশায়ারের কর্ডন হিল একটি ফ্যাকোলিথের উদাহরণ।
E) ল্যাকোলিথ (Lacolith) :
‘ল্যাকোলিথ’ শব্দটি জার্মান শব্দ ‘ল্যাকোস’ থেকে এসেছে। ‘ল্যাকোস’ শব্দের অর্থ শিলা। পাললিক বা যে কোনো অনুভূমিক শিলাস্তরে সজ্জিত আগ্নেয় উদ্ভেদকে ল্যাকোলিথ বলে। আগ্নেয় উদ্গিরণের সময় ভূগর্ভস্থ গ্যাস ও বাষ্প ওপরের দিকে সজোরে ওঠার সময় পাললিক শিলাস্তরের ওপরের স্তরটিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় ফলে ওপরের স্তরটি সামান্য গোলাকার হয়। সেইজন্য এইক্ষেত্রে আগ্নেয় উদ্ভেদটি ব্যাঙের ছাতা বা লেন্সের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট হয়। অনেকগুলি ল্যাকোলি একটির ওপর অপরটি সজ্জিত হয়ে সিডার বৃক্ষের ন্যায় জটিল আগ্নেয় অবয়ব সৃষ্টি করে। ছোটনাগপুর মালভূমিতে অনেক ল্যাকোলিথ দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উটা প্রদেশের হেনরি পর্বত ল্যাকোলিথের উদাহরণ। উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতের পূর্বদিকে বেশ কয়েকটি ল্যাকোলিথ দেখা যায়।
F) লপোলিথ (Lopolith) :
‘লপোলিথ’ শব্দটি জার্মান শব্দ ‘লপোস’ থেকে এসেছে। 'লপোস' শব্দের অর্থ বেসিন। যে সমস্ত ক্ষেত্রে ম্যাগমা ভূগর্ভস্থ কোনো অবনমিত স্থানে সঞ্চিত হয়, তখন তাকে ‘লপোলিথ' বলে। এক্ষেত্রে শিলার দানাগুলি বৃহদাকার কারণ ম্যাগমা অত্যস্ত ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়। এই ম্যাগমা শিলাস্তরের মাঝে জমাট বেঁধে সরার মতো যে ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, তাকে লপোলিথ বলে। এর ব্যাস 56.3 সেমি। যেমন—দক্ষিণ আফ্রিকার বুশভেল্ড এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভুলুথ গ্যারো। আফ্রিকার ট্রান্সভাল, ইউরোপের আল্পস্ এবং আটলাস পর্বতের নিম্নঢালে লপোলিথ গঠিত হয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ডুলুথে প্রায় 563 কিলোমিটার ব্যাসের একটি লপোলিথ অবস্থিত। দক্ষিণ ভারতের সিতামপুণ্ডিতে প্রাকৃকেম্ব্রিয়ন যুগের একটি লপোলিথ আছে। অবশ্য এখানে আগ্নেয়শিলা রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয়ে গিয়েছে।
G) কনোলিথ (Canolith) :
এই ধরনের আগ্নেয় উদ্ভেদ-এর সাথে অন্য কোন উদ্ভেদের কোনো মিল পাওয়া যায় না। এই ধরনের উদ্ভেদ বিষদ প্রকৃতির হয়ে থাকে। আফ্রিকার কারো অঞ্চলে এটি দেখা যায়।
H) বিসমালিথ ( Bysmalith) :
কোনো বৃত্তাকার ফাটলের মধ্যে আগ্নেয় পদার্থ জমা হয়ে যে ভূমিরূপ গঠন করে তাকে বিসমালিথ বলে। এর খুব খাড়া হয়, লাভা খুব সান্দ্র প্রকৃতির হয়। এর প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠে বৃত্তাকার শিলাচ্যুতি ঘটে। এটি দক্ষিণ ডাকোটার ব্লাও ছিল এ দেখা যায়।
Comments
Post a Comment