বিস্ফোরক বা কেন্দ্রীয় অগ্ন্যুৎপাতের শ্রেণীবিভাগ(Classification of Explosive or Central Eruption)
বিস্ফোরক বা কেন্দ্রীয় অগ্ন্যুৎপাত (Explosive or Central Eruption):
ভূ-অভ্যন্তরের ম্যাগমা চেম্বার বা ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ থেকে লাভা বা ম্যাগমা যখন কোনো পাইপের মতো দীর্ঘাকৃতির পথের মাধ্যমে বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার এক বা একাধিক জ্বালামুখের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠে নির্গত হয় তখন সেই অগ্ন্যুৎপাতকে কেন্দ্রীয় অগ্ন্যুৎপাত বলে। জ্বালামুখের মাধ্যমে এই অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে একে জ্বালামুখ অগ্ন্যুৎপাতও বলে। একটি কেন্দ্রীয় উদ্গীরণ নল এবং স্বল্প আয়তনের জ্বালা মুখ দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের তরল ও গ্যাসীয় পদার্থসমূহ বের হয়ে এরূপ অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়। এগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও লাভা এত জোরে উৎক্ষিপ্ত হয় যে, আকাশে হাজার হাজার মিটার উঁচুতে পর্যন্ত যেতে পারে। এসব উৎক্ষিপ্ত পদার্থ নীচে নেমে এসে আগ্নেয় জ্বালামুখের চারপাশে বিভিন্ন আকার আকৃতিতে জমাট বেঁধে বিভিন্ন ধরনের ঢালবিশিষ্ট উচ্চভূমির সৃষ্টি করে। এধরনের অগ্ন্যুৎপাত ধ্বংসাত্মক এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। তাই কেন্দ্রীয় অগ্ন্যুৎপাতকে বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত (Explosive Eruption) ও বলা হয়ে থাকে। এই অগ্ন্যুৎপাতকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে—
◆◆) হাওয়াই শ্রেণী (Hawaiian Type) :
এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতে কোনোরকম বিস্ফোরণ হয় না। ভূ-গর্ভের ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে লাভা বাইরে বেরিয়ে আসে। যেহেতু হাওয়াই দ্বীপের অধিকাংশ আগ্নেয়গিরি থেকে এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাত হয়, তাই এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাতকে ‘হাওয়াই দ্বীপের অগ্ন্যুৎপাত’ বলে। হাওয়াই দ্বীপের অধিবাসীরা অগ্নি দেবতা পিলির নাম অনুসারে একে ‘পিলির কেশ’ বলে। ভূ-বিজ্ঞানীরা হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত ঢালের মতো আকৃতিবিশিষ্ট আগ্নেয়গিরিকে শিল্ড আগ্নেয়গিরি বলে। এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাত থেকে উৎক্ষিপ্ত তরল লাভা সুতোর মতো বাতাসে উড়তে থাকে। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ক্যালডেরা হ্রদের সৃষ্টি হয়। লাভা সঞ্চিত হয়ে গম্বুজ আকৃতি পাহাড় গঠন করে। এর ঢাল 5°-এর কম হয়। এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাতের লাভা ভূ-পৃষ্ঠের বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মৌনা লোয়া (Mauna Loa) এই শ্রেণীর উপযুক্ত নিদর্শন।
◆◆) আইসল্যান্ড শ্রেণী (Ice Land Type) :
ভূত্বকের কোনো ফাটল বা ছিদ্রপথ বা দুর্বল স্থান দিয়ে কোন রকম বিস্ফোরণ ছাড়াই ভূপৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে এসে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, একে আইসল্যান্ড শ্রেণী অগ্ন্যুৎপাত বলে। এটি মূলতঃ আইসল্যান্ড দ্বীপেই হয়ে থাকে। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতে গ্যাসের পরিমাণ কম থাকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাসল্ট জাতীয় লাভা জমাট বেঁধে লাভা মালভূমির সৃষ্টি করে। এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রশস্ত ঢালবিশিষ্ট ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়। আইসল্যান্ড ছাড়া ভারতের লাভা মালভূমি ও রাজমহল পাহাড়, উত্তর আমেরিকার স্নেক নদী অববাহিকার মালভূমি, ব্রাজিলের গিয়ানা মালভূমি এবং দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া মালভূমিতে এরূপ অগ্ন্যুৎপাত হয়ে থাকে।
◆◆) স্ট্রোম্বলিয় শ্রেণী (Strombolian Type)
মাঝারি ধরনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এধরনের আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত হয়ে থাকে। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সিসিলির উত্তরে লিপারি দ্বীপের স্ট্রোম্বলি আগ্নেয়গিরি থেকে এধরনের অগ্ন্যুৎপাত ঘটে বলে একে স্ট্রোম্বলিয় শ্রেণী বলা হয়। এধরনের অগ্ন্যুৎপাত সামান্য বিরতি দিয়ে কিছুদিন পরপর হয়। এরকম অগ্ন্যুৎপাতে লাভা তেমন ঘন হয় না বলে দুটি বিস্ফোরণের মধ্যবর্তী সময়ে লাভার উপর সরের মতো পাতলা আবরণ তৈরী হয়। এ ধরনের আগ্নেয়গিরি থেকে উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলিত গ্যাস নির্গত হয় বলে স্ট্রোম্বলিকে ভূমধ্যসাগরেরআলোকস্তম্ভ বলা হয়।
এই ধরনের আগ্নেয়গিরি জ্বালামুখে হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতে লাভা জমাট বেঁধে ঝামার মতো আকৃতিবিশিষ্ট পাহাড় সৃষ্টি করে। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাত থেকে উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলিত গ্যাস নির্গত হয়। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাত থেকে নির্গত লাভা অপেক্ষাকৃত কম তরল বা সান্দ্র বলে দ্রুত জমাট বাঁধে। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতে ভস্ম খুব কম পরিমাণে থাকে কিন্তু বাষ্প ও অন্যান্য গ্যাস বেশি পরিমাণে থাকে। এই ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের লাভা তাপমাত্রা 100-1100° সেন্টিগ্রেড হয়ে থাকে।
★★) ভলক্যানীয় শ্রেণী (Vulcanian Type) : এই জাতীয় অগ্ন্যুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরিতে জোরালো বিস্ফোরণ ঘটে এবং অগ্ন্যুৎপাতের সময় প্রচুর পাথর খণ্ড উৎক্ষিপ্ত হয়। লিপারি দ্বীপের ভালক্যানো আগ্নেয়গিরির নামানুসারে এই আগ্নেয়গিরির নামকরণ করা হয়েছে। এই আগ্নেয়গিরির উৎক্ষিপ্ত লাভা অত্যন্ত সান্দ্র (Viscous) এবং বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রস্তরখণ্ড ঊর্ধ্বে নিক্ষিপ্ত হয়। এই আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত গ্যাসপুঞ্জ ও ভস্ম ফুলকপির আকারে কালো মেঘ গঠন করে স্থানীয় আকাশ পরিব্যাপ্ত করে। এই অগ্ন্যুৎপাতকে ভলক্যানীয় শ্রেণীর অগ্ন্যুৎপাত বলা হয়। এজাতীয় আগ্নেয়গিরির লাভা অত্যন্ত আঁঠালো। ফলে একবার অগ্ন্যুৎপাতের পর দ্বিতীয় অগ্ন্যুৎপাতের সময়ের ব্যবধানের মধ্যেই তা জমাট বেঁধে জ্বালামুখ বন্ধ করে দেয়। ফলে পরবর্তী অগ্ন্যুৎপাতের পূর্বে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাপে জোরালো বিস্ফোরণ ঘটে। এ ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত গ্যাস সোজা উপরে উঠে গিয়ে পরে প্রসারিত হয়।
★এটনা-এভিসুভিয়াস শ্রেণী (Etna-Visuvias type) :
ইটালী নেপলস্ শহরের নিকট এটনা (সিসিলি দ্বীপে ও ভিসুভিয়াস, নেপলসের কাছে) আগ্নেয়গিরিতে এরূপ অগ্ন্যুৎপাত হতে দেখা যায় বলে একে ভিসুভিয়াস অগ্ন্যুৎপাত বলা হয়। এক্ষেত্রে শুধু লাভার ঘনত্ব নয়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে ভৃগর্ভে লাভার এবং অন্যান্য বস্তুর উৎক্ষেপন শক্তির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। ফলে দুটি বিস্ফোরণের মধ্যে ব্যবধান কয়েক দশক হয়ে থাকে। এরকম অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে বস্তুসমূহ শূন্যে বহুদূর পর্যন্ত উৎক্ষিপ্ত হয়। আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে সঞ্চিত ম্যাগমা নির্গত হওয়ার পর প্রচুর গ্যাস বের হয়ে আসে এবং পরে তা ফুলকপির আকার ধারণ করে। নিসৃত গ্যাসের সাথে প্রচুর পরিমাণে ছাই, ধোঁয়া ইত্যাদি মিশ্রিত থাকে।
★★) প্লিনিয় শ্রেণী (Plinian Type) :
পৃথিবীর সর্বাধিক বিধ্বংসী এবং বিস্ফোরণ সম্ভাবনাময় অগ্ন্যুৎপাতকে প্লিনীয় শ্রেণির অগ্ন্যুৎপাত বলা হয়। ‘প্লিনি’ নামে জনৈক ভূবিজ্ঞানীর নাম স্মরণীয় করে রাখার জন্যে এজাতীয় অগ্ন্যুৎপাতের এরূপ নামকরণ হয়েছে। 1979 খ্রিস্টাব্দে প্লিনি নামে একজন ভূবিজ্ঞানী ভিসুভিয়াসের বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাত (যাতে পম্পাই ও হারকুলেনিয়াম ধ্বংস হয়) সমীক্ষা করার জন্যে সেখানে যান। অগ্ন্যুৎপাতের পর আকাশ থেকে পড়া এক আগ্নেয় বোমার আঘাতে তিনি মারা যান। তার ভাইপোর লেখা এক পাণ্ডুলিপি থেকে এই অগ্ন্যুৎপাতের পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাতে কঠিন পাথরের টুকরো, আগ্নেয় বোমা, গলিত লাভা, ছাই, জ্বলন্ত গ্যাস ইত্যাদি একই সঙ্গে প্রবল বেগে ওপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময়ে 10-12 কিলোমিটার ঊর্ধ্বে দাহ্য গ্যাসের সঙ্গে প্রস্তরখণ্ড উঠে আসে। এই প্রকার অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরণের শব্দ বহু দূর থেকে শোনা যায় এবং নিক্ষিপ্ত ছাই বহু দূর দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
★★) পিলীয় শ্রেণী (Pelean Type) :
লেসার অ্যান্টিলিস দ্বীপপুঞ্জের (Lasser Antilles Islands) মার্টিনিক (Martinique) দ্বীপে পিলি আগ্নেয়গিরি অবস্থিত। এর অগ্ন্যুৎপাতে মধ্যবর্তী শ্রেণীর অ্যান্ডেসাইট লাভা উদ্গিরিত হয়। এটা খুবই সান্দ্র ও গ্যাস সম্পৃক্ত থাকে। আগ্নেয়গিরির নলের মধ্যে সান্দ্র লাভা নিষ্পেষিত হয়ে এক গম্বুজ তৈরি করে। এই গম্বুজের নীচে লাভার মধ্যস্থিত গ্যাস বার হতে পারে না। ফলে গ্যাসীয় চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এক সময় ফেনার মতো এই গ্যাস গম্বুজের ভূমিদেশে কোনো এক দুর্বল স্থান ভেদ করে, প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। আগ্নেয়গিরির পাশ দিয়ে এভাবে প্রায় সমান্তরালে লাভা ও গ্যাস নির্গত হলে (বা বেরিয়ে এলে) তাকে ফরাসি ভাষায় নুয়ে আর্দেস্তি (Nue ardente) বলা হয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মাউন্টপিলি আগ্নেয়গিরি থেকে এ ধরনের অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে এ জাতীয় অগ্ন্যুৎপাত পিলীয় শ্রেণীর অগ্ন্যুৎপাত নামে পরিচিত। 1902 সালে মাউন্ট পিলি থেকে এরকম নুয়ে আর্দেস্তি প্রবাহের ফলে সেন্ট পিয়ারি শহরের 30,000 মানুষ যায়।
★★) ক্রাকাতোয়া শ্রেণী (Krakatoa Type) :
জাভা ও সুমাত্রার মধ্যবর্তী সুন্ডা প্রণালীতে ক্রাকাতোয়া একটি দ্বীপ ও তিনটি আগ্নেয়গিরির সমষ্টি বিশেষ ছিল। 1883 খ্রিস্টাব্দে আগস্টে এই আগ্নেয়গিরি থেকে সবচেয়ে প্রলয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় যদিও উক্ত দিনের কয়েক মাস আগে থেকেই কিছুদিন ব্যবধানে ক্রমবর্ধমান বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছিল কিন্তু ওই দিনে যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয় তার আওয়াজ 4000-5000 কিমি দূরে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়া থেকে শোনা গিয়েছিল। গ্যাস ও ভস্ম মিশ্রিত উত্তপ্ত রাঙা মেঘ ৪০ কিমি. ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। এই বিস্ফোরণের ফলে এই দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয় এবং জলের লায় 6.4 × 7.2 কিমি. আয়তনের এক বিরাট ক্যালডেরার সৃষ্টি হয়। অবশ্য এই ক্যালডেরার উৎপত্তিতে বিস্ফোরণের ভূমিকা অল্পই ছিল। ভূমির অবনমনই এর সৃষ্টির জন্য প্রধানত দায়ী।
Comments
Post a Comment