হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

 হড়পা বান (Flash Flood)

হড়পা বান এক ধরনের দুর্বিপাক বা বিপর্যয়, যা আকস্মিকভাবে পরিবেশে উপস্থিত হয়। হড়পা বান হল স্বল্প এলাকা জুড়ে সংঘটিত দ্রুত গতির বন্যা। সাধারণ বন্যার (regular flood) সঙ্গে হড়পা বানের পার্থক্য কেবল সময়ের পরিসরে (time scale)। সাধারণ কন্যা যেখানে দীর্ঘ সময় জুড়ে বিরাজ করে, সেখানে হড়পা বানের স্থায়িত্ব খুবই কম এবং দ্রুত গতিতে ঘটে থাকে। স্বল্প স্থান জুড়ে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মাত্র 6 ঘণ্টার (Six hours between rainfall and the onset of flooding) মধ্যেই হড়পা যান উপস্থিত হয় ।


           প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে হড়পা বানের স্থান বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন এবং বিশ্ব-উন্নায়ন জনিত কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য হড়পা বানের উপস্থিতির সংখ্যাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ জলচক্রের (hydrological cycle) মধ্যেও অস্বাভাবিক পরিবর্তন হড়পাবানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে ।


. হড়পা বানের বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Flash Flood)


1. হড়পা বান ও উদকবিদ্যা (Flash flood and Hydrology) :

 হড়পা বানের সঙ্গে উদকবিদ্যা বা জলবিদ্যার (Hydrology) ঘনিষ্ট সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। হড়পা বানের পদ্ধতির বিশ্লেষণ উদকবিদ্যায় অসম্ভব মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ। যে এলাকায় হড়পা বান সংঘটিত হয়, সেই এলাকার উদকগত পরিবেশ (hydrological behaviour) সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয় ।


2. উচ্চমাত্রায় সুতীব্র বৃষ্টিপাত (High-intensity rainfall) ঃ 

হড়পা বানের সঙ্গে উচ্চমাত্রার সুতীব্র বৃষ্টিপাত গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। স্থানীয়ভাবে পরিচলন প্রক্রিয়ায় (mainly of convective origin that occur locally) সৃষ্ট ভারী বর্ষণ হড়পা বানকে ত্বরান্বিত করে। সাধারণ বন্যার সময়ে পৃষ্ঠপ্রবাহের (Surface runoff) যে গতিবেগ লক্ষ করা যায়, তার তুলনায় হড়পা বানের সময়ে সৃষ্ট পৃষ্ঠপ্রবাহের গতিবেগ কয়েক গুণ বেশি হয়। ধারণ অববাহিকায় মৃত্তিকার গুণাগুণ, শিলালক্ষণজনিত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর হড়পা বানের ভয়াবহতা করে ।


3. স্থানিক ও সময় পরিসর (Spacial and temporal Scales) ঃ

 হড়পা বানের স্থানিক পরিসর অত্যন্ত কম। সময়ের পরিসরও স্বাভাবিক বন্যার তুলনায় অনেকটাই কম, অর্থাৎ হড়পা বানের স্থায়িত্ব একেবারেই কম। বান চলাকালীন জলপ্রবাহের গতিবেগ পরিমাপ করা বেশ দুরূহ কাজ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়না। ইউরোপে শেষ দু’দশকে (20 বছর) প্রায় 25টি হড়পা বান পর্যবেক্ষণ করে, মাত্র কয়েকটির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে জলের গতিবেগ পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে  |


4. দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া (Hazardous Weather) :

 হড়পা বানের সঙ্গে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রবল বর্ষণ বা ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে বজ্রঝঞ্ঝাও যুক্ত থাকে। পার্বত্য অঞ্চলের বরফ-গলন ও প্রবল দমকা বাতাস সমগ্র আবহাওয়ার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে (National Weather Service, 2017 ।



★★★ হড়পা বানের কারণসমূহ (Causes of Flash Flood)


1. মেঘ বিস্ফোরণ (Cloud burst) : 

মেঘ বিস্ফোরণের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে অত্যধিক মাত্রায় বৃষ্টিপাত হলে হড়পা বানের উৎপত্তি হয়। বৃষ্টিপাতের তীব্রতার ওপর এই বানের ভয়াবহতা নির্ভরশীল। ঘণ্টায় 100 মিলিমিটার বা তারও বেশি বৃষ্টিপাত হলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি সক্রিয়তার প্রভাবে হিমালয় অঞ্চল ও পশ্চিমঘাট অঞ্চলে প্রবল মাত্রায় শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাতের মাধ্যমেও হড়পা বানের উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়। সমভূমি অঞ্চলে সংঘটিত হলেও, তবে তা সংখ্যায় অনেক কম (Jain, et al. 2013) |


           মৌসুমির দীর্ঘায়িত নিম্নচাপ বা মৌসুমি বায়ুর ট্রাফ (Monsoon trough) এবং মৌসুমি ডিপ্রেসন (Monsoon depres sion) মেঘ বিস্ফোরণের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে। এর ফলে প্রবল বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। বৃষ্টির জল যখন অল্প স্থানের ওপর দিয়ে পৃষ্ঠ প্রবাহ বা উপপৃষ্ঠ প্রবাহ হিসাবে নিষ্কাশিত হয় (When the rainfalls in an area with limited surface and sub-surface drainage), তখনই হড়পা বানের আবির্ভাব ঘটে। আবার যখন খাড়াই ঢাল বরাবর অতি সংকীর্ণ খাতের মধ্য দিয়ে এই জল প্রবাহিত হয় তখন বিধ্বংসীরূপে স্থানীয়ভাবে হড়পা বানের সৃষ্টি হয় (Shrestha, Sale & Karim, 2008)| 2013 খ্রিস্টাব্দে 16-17 জুন মাত্র 24 ঘণ্টায় উত্তরাখণ্ডে 376 মিমি বৃষ্টিপাত হয় (দেরাদুনে রেকর্ড হয়। দেরাদুনে জুন মাসে যেখানে গড় বৃষ্টি 210 মিমি, সেখানে জুলাই ও আগস্ট মাসে ওই বছর 600 মিমির বেশি বৃষ্টিপাত হয়, যার পরিণতিতে উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানের উৎপত্তি (Jain, et al., 2013) |


উদাহরণ : 2012 খ্রিস্টাব্দে উত্তরকাশী অঞ্চলে যে বিধ্বংসী হড়পা বানের আবির্ভাব ঘটে তা মূলত মেঘ বিস্ফোরণের মাধ্যমে অত্যধিক মাত্রায় বৃষ্টিপাতের জন্যই হয়ে থাকে। 2004 খ্রিস্টাব্দের 4 মে পাকিস্তানের চিট্রাল-এ (Chitral, Pakistan) বিকেল 5 টার সময় প্রায় 1 ঘণ্টা ধরে প্রবল বজ্রবৃষ্টি সংঘটিত হয় এবং প্রায় 30 মিনিট ধরে শিলাবৃষ্টি (hailstorm) চলতে থাকায় বিধ্বংসী হড়পা বানের উৎপত্তি হয় (ICIMOD, 2010)


2.মারাত্মক ভূমিধস (Severe landslides) :
পার্বত্য অঞ্চলে অতিরিক্ত মাত্রায় বৃষ্টিপাতজনিত কারণে যে ভূমিধসের সৃষ্টি হয়, তার কারণেও হড়পা বান হয়ে থাকে। তবে এই ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান হড়পা বানের ভয়াবহতাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ধসজনিত অবস্করসমূহ যেমন নদীবক্ষে সঞ্চিত হয়ে এক ধরনের বাঁধ তৈরি করে হড়পা বানের পথ প্রসপ্ত করে, তেমনি ধসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত হিমানী সম্প্রপাত, অবস্কর প্রবাহ, শিলা ও অবস্থার পতন হড়পা বালেতা প্রক্রিয়াকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে। অতি উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নত রিমোট সেন্সিং পদ্ধতিতে বর্তমানে বোঝা যায় পার্বত্য অঞ্চলের অকস্মাৎ ভূমিধস হড়পা বানের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে (Science Reporter, 2013) 

উদাহরণঃ 2004 খ্রিস্টাব্দে অলকানন্দা নদী অববাহিকায় মেঘ বিস্ফোরণের জন্য যে মারাত্মক ভূমিধস নামে, তার প্রভাবে
বিশাল মাপের হড়পা বান আবির্ভূত হয়। 2009 খ্রিস্টাব্দেও এই একই কারণে উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলাতে মারাত্মক হড়পা বানের সৃষ্টি হয় (Jain, et al., 2013)

3. তুমার ও বরফের গলন (Snow and Ice melt):
 সামগ্রিকভাবে ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য পার্বত্য অঞ্চলে তুষার ও বরফের গলন লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ধারণ অববাহিকার মধ্যে একসঙ্গে অত্যধিক মাত্রায় জলপ্রবাহের সূচনা হয়। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে যদি মেঘ বিস্ফোরণজনিত বৃষ্টিপাত এবং সেই সঙ্গে তুষার বা বরফের গলন একসঙ্গে মিলিত হয়ে নদীর মধ্যে উপস্থিত হয়, তখন ওই পরিমাণ জল উপত্যকা ধারণ করতে পারেনা। তাই আকস্মিকভাবে হড়পা বানের মতো ভয়াবহ দুর্যোগের পরিবেশ গড়ে ওঠে।

 উদাহরণঃ উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে এই কারণেই অনেক ছোটো-বড়ো হড়পা বানের উৎপত্তি হয়।

4. বরফ জট বা বরফ জ্যাম (Ice jam) : 
সাম্প্রতিককালে বরফ জটজনিত কারণেও হড়পাবান উল্লেখ্যমাত্রায় উপস্থিত হয়। পার্বত্য অঞ্চলে ধারণ অববাহিকার মধ্যে ছোটো ছোটো অনেক নদীর জল প্রচণ্ড শীতলতায় বরফের রূপ ধারণ করে। তাই নদীর মধ্যে স্বাভাবিক জলপ্রবাহের গতি স্ত হয়। প্রবাহপথ অবরুদ্ধ হয় বরফজ্যাম দ্বারা। এমতাবস্থায় মেঘ বিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রবল ভারী বৃষ্টিপাত সংঘটিত হলে ওই জল নদী দ্বারা নিষ্কাশিত হতে পারেনা। তাই এই পরিস্থিতিতে হড়পা বানের উৎপত্তি হয়। উদাহরণঃ উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ অঞ্চলে 2013 খ্রিস্টাব্দে ভারী তুষারপাতের (Heavy snowfall) কারণে জুন মাসে মারাত্মক হড়পা বানের সৃষ্টি হয় (Sati & Gahalaut, 2013)


5. স্থিতিশীল অববাহিকার প্রকৃতি (Nature of Stable basin) : 
পার্বত্য অঞ্চলে ধারণ অববাহিকার মধ্যে বেশ কিছু স্থিতিশীল পরিস্থিতি বা বিষয় বর্তমান, যেগুলির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হলে হড়পা বানের উৎপত্তি হতে পারে। এই সব বিষয়ের মধ্যে ক্ষেত্রমান (area), ঢাল, আকৃতি, ভূমির ঢালের দিক (aspect) এবং উচ্চতা উল্লেখযোগ্য। অববাহিকার ক্ষেত্রমান হ্রাস, ঢাল বৃদ্ধি, আকৃতি যদি সংকীর্ণ (narrow) হয়, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে মেঘ বিস্ফোরণের মাধ্যমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের দ্বারা


Comments

Popular posts from this blog

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)