মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

 ★ মৌসুমি বিস্ফোরণ (The Burst of the Monsoon)


জুন মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হঠাৎ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আকস্মিকভাবে সৃষ্ট এই ধরনের নিম্নচাপজনিত দমকা বায়ুসহ বৃষ্টিপাতকে বলা হয় মৌসুমি বিস্ফোরণ। সুতরাং, মৌসুমি বায়ুর আগমনের উদ্বোধনী ঘটনা হল মৌসুমি বিস্ফোরণ। আসলে, মৌসুমি বায়ু স্থলভাগে পৌঁছানোর আগে সামান্য হালকা ধরনের বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। কিন্তু তারপর যখন মৌসুমি। বায়ু আকস্মিক ও সক্রিয়ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করে, তখনই তাকে মৌসুমি বিস্ফোরণ বলা হয়


মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তি (Genesis of Burst of Monsoon) : 


মৌসুমি বায়ু মূল ভূ-খণ্ডে আকস্মিকভাবে প্রবেশ করে। তখন এই বায়ুর গতিবেগও হঠাৎ করে বেড়ে যায়। কিন্তু এই বায়ুর গতিবেগ কেন আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়, তার কোন সর্বজনগ্রাহ্য মতামত পাওয়া যায় না। মৌসুমি বায়ুর অতি সক্রিয় প্রবাহ বা উচ্ছ্বাস (surge) সাধারণ প্রবাহের গতিবেগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়। খুব সম্ভবত বায়ুর গতিবেগজনিত অভিসরণের (velocity convergence) জন্যই সামনের দিকে বায়ুর গতিবেগ বৃদ্ধি পায় ।


মৌসুমি বিস্ফোরণের কারণকে নিম্নলিখিতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—


1. দক্ষিণ এশিয়ায় ঊর্ধ্ব বায়ুর সঞ্চালন (Upper-air circulation over Southern Asia) :

ভারতে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর আগমন অত্যন্ত আকস্মিক এবং নাটকীয় (abrupt and dramatic)।মৌসুমির আগমন সর্বদাই বিশুদ্ধ আবহাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। মৌসুমি বিস্ফোরণের কারণ হিসাবে সর্বাধিক প্রচলিত ধারণাটি হল—দক্ষিণ এশিয়ার উপর ঊর্ধ্ব বায়ুর সঞ্চালনের হঠাৎ করে পরিবর্তনের ফলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।


                      এপ্রিল-মে মাসে উত্তর গোলার্ধের ভারতীয় উপমহাদেশে লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মির কল্যাণে ভূ-ভাগ প্রচণ্ড পরিমাণে উত্তপ্ত (insolational heating) হয়। এর ফলে উত্তর ভারত এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে গভীর নিম্নচাপ ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। এই নিম্নচাপের আকর্ষণেই পার্শ্ববর্তী উগ্ন সমুদ্র (from warm ocean) থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন হয়।


           ভারতে আবির্ভূত হওয়া এই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রাথমিক অবস্থায় উত্তর দিকে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না। কারণ এই সময়ে উত্তর ভারতে উপক্রান্তীয় পশ্চিমী জেট সক্রিয় থাকে। এই পশ্চিমী জেট দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উত্তরদিকে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মে মাসের শেষ কিংবা জুন মাসের প্রথম দিকে উত্তর ভারতে উন্নতার পরিমাণ অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। তাই হিমালয়ের দক্ষিণভাগ দিয়ে প্রবাহিত উপক্রান্তীয় জেট বায়ু হিমালয়ের উত্তরে স্থানান্তরিত হয়ে তিব্বতে অবস্থান করে। এই সময়েই ঊর্ধ্ব প্রোণিটি (upper trough) 85° পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে পশ্চিম দিকে সরে 75° পূর্ব ব্রাঘিমায় অবস্থান করে। জেট বায়ুর এই স্থানান্তর মোটেই ধীরগতিতে হয় না (Jet stream does not retreat slowly)। স্থানান্তর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে (very quick) হয়। জেট বায়ু যখন ভারত থেকে পুরোমাত্রায় অদৃশ্য (disappearance) হয়ে যায়, তখনই ভারতীয় ভূ-ভাগে সমুদ্রের দিক থেকে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ প্রতিষ্ঠিত (definite monsoon circulation from the sea on to the land is established) হতে দেখা যায়।


                      দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মে মাসের শেষ থেকে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ শুরু হয়। কিন্তু ভারতে একটু দেরি হয়। জুন মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ সুনিশ্চিত হয়। স্থানবিশেষে এই বায়ুর আগমন যথেষ্ট অনিশ্চিতও বটে। ভারতে এই বায়ুর আকস্মিক আগমন ঋতুভেদে আন্তঃক্রান্তীয় অভিসরণ অঞ্চলের (ITCZ) স্থানান্তরের ফলেই ঘটে থাকে (Lal, 1998) ।


2. তিব্বতীয় উচ্চভূমিতে সৃষ্ট উন্ন-কেন্দ্রীয় প্রতীপ ঘূর্ণবাত (Warm-core anticyclone over Tibetan Highland) : 


গ্রীষ্মকালে তিব্বতীয় উচ্চভূমিতে একপ্রকার উপ-কেন্দ্রীয় প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। মৌসুমি বিস্ফোরণ, তিব্বতীয় উচ্চভূমির প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল। ঊর্ধ্ব বায়ুস্তরে সৃষ্ট বায়ু এক ধরনের জেট বায়ুর সৃষ্টি করে। এই জেট বায়ুর নাম পুবালি জেট (Easterly Jet)। অক্ষাংশের কাছাকাছি ভারতের আকাশে এই বায়ুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জেট বায়ুর এই অবস্থান সাধারণ নিয়ত বায়ুপ্রবাহ বিন্যাসের মধ্যে পুনঃসমঝোতা হয়ে থাকে (readjustment in general planetary circulation patterns)। ধীরে ধীরে এই বায়ু সমগ্র ভারতসহ পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। ঊর্ধ্ব বায়ুস্তরে সৃষ্ট এই ধরনের জেট বায়ু ভারতীয় উপমহাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনের অনুকূল পরিবেশ রচনা করে। এই কারণে সমগ্র ভারতেই মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ সচল থাকে। দক্ষিণ ভারতে মৌসুমি বায়ুর গভীরতা 6.5 কিমি হলেও গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে এর গভীরতা মাত্র ১ কিমি। এই মৌসুমি বায়ুর উপরে পুবালি জেট বায়ুর একটি স্তর (overlyn by a layer of ensterly with লক্ষ্য করা যায় ।


           সুতরাং, বিস্ফোরণের মাধ্যমে মৌসুমি বায়ু উপকূল অঞ্চলে হঠাৎ করে ফেটে পড়ে। ঘটনাটি অত্যন্ত দ্রুত বা আকস্মিকভাবে হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু ভারতীয় ভূ-খণ্ডে প্রবেশের প্রাক্কালে দেখা যায়, কেরালার অদূরে আরবসাগরে এবং ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের নিকটস্থ বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ কোশের (low pressure cell) সৃষ্টি হয়। নিম্নচাপটি আরো গভীর ও ঘনীভূত হয়ে ডিপ্রেসন (depression)-এ পরিণত হয়। এই ধরনের নিম্নচাপ কোশ মৌসুমি বায়ুর আগমনের পথ পরিষ্কার করে। মৌসুমি বায়ুকে টেনে নিয়ে আসে বলে এই ধরনের নিম্নচাপ কোশকে আগমনকালীন ঘূর্ণিবাত্যা (onset vortex) বলা হয়। আগমনকালীন ঘূর্ণিবাত্যার মাধ্যমেই মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।

Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)