আদমশুমারি বা জনগণনা: সংজ্ঞা,বৈশিষ্ট্যসমূহ, উদ্দেশ্য,পদ্ধতি,গুরুত্ব-geographyhonour
■ আদমশুমারি বা জনগণনা (Census of
Population) :
‘Census’ কথাটি ল্যাটিন শব্দ ‘Censere’ থেকে এসেছে। যার অর্থ মূল্য বা কর। জনসংখ্যা বিজ্ঞানীরা ‘Census'" কথাটিকে দেশের জনগণনা বা আদমশুমারি হিসাবে ব্যবহার করেন। প্রাচীনকালে জনগণনার কাজ মিশর, ব্যবিলন, চীন, প্যালেস্টাইন ও রোমে শুরু হয়েছিল। রোমে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জনগণনা করা হত। 1881 সালে ভারতে প্রত্যেক 10 বছর অন্তর পুর্নাঙ্গ জনগণনা শুরু হয়। 1749 সালে সুইডেন, 1769 সালে ডেনমার্কে ও নরওয়ে 1801 সালে ইংল্যান্ডে এবং 1829 সালে বেলজিয়ামে ও ফ্রান্সে 1835 সালে জনগণনা শুরু হয়।
সংজ্ঞা (Definition) :
আদমশুমারি হল কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকার কিংবা দেশের সকল ব্যক্তির জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ এবং তাকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ ও প্রকাশনার একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে আদমশুমারি বলে।
“Fundamental of population Geography' পুস্তকে বি.এন. ঘোষ (Cencus) (B.N.Ghosh) বলেন-
“A census is an enumeration at a specitic time of individuals inhabiting a specified area during which operation particulars are collectedregarding age-sex, marital status, occupation. religion etc."
• আদমশুমারি বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Population Census ) :
(i) আদমশুমারি নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিচালিত হয়। যেমন—ভারতে দশ বছর অস্তর।
(ii) আদমশুমারি থেকে জনসংখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সরাসরি সংগ্রহ করা হয়।
(iii) আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত তথ্যকে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা হয়।
(iv) আদামসুমারিতে তথ্য সংগ্রহের দুটি পদ্ধতি, যথা— Defacto ও Dejure পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
(v) আদমশুমারিতে দেশের প্রত্যেক জনগণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
(vi) এই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহর পূর্বে প্রত্যেক এলাকাতে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভাগ করে তথ্য আহরণ করা হয়।
(vii) প্রত্যেক ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য পৃথক পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়।
(viii) যেকোন দেশের জনগণের তথ্যবহুল চিত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিশেষ কার্যকরী।
(ix) তথ্য সংগ্রহর জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষিত কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।
• আদমশুমারির উদ্দেশ্য (Objectives of Population Census ) :
(i) জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য :
আদমশুমারি সাহায্যে জনসংখ্যা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জনগণের বয়স, লিঙ্গ, জীবিকা, আয়, পারিবারিক কাঠামো, বয়স ভিত্তিক লিঙ্গ অনুপাত প্রভৃতি তথ্যগুলি জানা যায়।
(ii) জন্ম, মৃত্যু ও পরিযান :
আদমশুমারি থেকে জন্মহার মৃত্যুহার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নির্ভরশীলতার অনুপাত ও জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক প্রভৃতি বিভিন্ন জটিল বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়।
(iii) অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য :
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যেমন কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনগণের জীবনধারা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি তথ্যগুলি আদমশুমারি থেকে সংগ্রহ করা হয়।
(iv) শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন :
আদমশুমারি থেকে শিক্ষার অবস্থা, শিশু শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, নারী ও পুরুষের শিক্ষার হার এবং স্বাস্থ্যনীতি, পুষ্টি, খাদ্য প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যেমন-2011 সালের আদমশুমারির অনুসারে ভারতে সাক্ষরতার হার 74.04 %1
(v) পারিবারিক তথ্য আহরন :
আদমশুমারি থেকে কোন দেশ বা স্থানের সকল মানুষের পারিবারিক তথ্য বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়। পরিবারের আকার ও আকৃতি, আবাসন, তাদের জ্যামিতিক বিন্যাস প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি সহজেই পাওয়া যায়।
(vi) জননীতির প্রয়োগ :
আদমশুমারি থেকে দেশের জনসংখ্যার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। কোন স্থানে কীভাবে জননীতি প্রয়োগ করা হবে এবং জননীতি প্রয়োগের ফলে তার কুফলও সুফল এবং তার সর্বশেষ তথ্য শুধুমাত্র আদমশুমারি থেকেই পাওয়া যায়।
(vii) পরিব্রাজন সম্পর্কে তথ্য আহরন :
আদমশুমারি থেকে কোন দেশের আগমন ও বহির্গমন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেমন 2011 সালের আদমশুমারি তে ভারতবর্ষে প্রচুর মানুষ পরিব্রাজনের আওতায় পড়েছে। যা দেশের মোট জনসংখ্যার 30%।
(viii) উন্নয়ন ও পরিকল্পনা :
উন্নয়ন ও পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে আদমশুমারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন অঞ্চল বা দেশের জনসংখ্যার পরিমান কত এবং জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক কীরূপে এবং কীভাবে পরিকল্পনা নেওয়া হবে, তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় এই আদমশুমারি থেকে। যেমন 2011 সালের আদমশুমারি তে ভারতের জনসংখ্যা 121 কোটি 1 লক্ষ 43 হাজার 422 জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমান 17.64%।
• আদমশুমারির পদ্ধতি (Methods Population Census):
জনসংখ্যা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আহরনের জন্য যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তাকে আদমশুমারি গণনা পদ্ধতি বলে। ইহার দুটি পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হল—
A. কার্যত পদ্ধতি (Defacto Method)
B. বিধানত পদ্ধতি (Dejure Method)
A. কার্যত পদ্ধতি (Defacto Methods) :
সংজ্ঞা বা (Definition):
যে ব্যক্তি বা লোক গণনার সময় যে স্থানে থাকে সেখানেই তাকে গণনা করা হয়, তাকে কার্যত পদ্ধতি বলে।।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) জনগণনার সময় যে ব্যক্তি যেখানেই থাকে সেখানেই তাকে গণনা করা হয়।
(ii) কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয়।
(ii) এই গণনা পদ্ধতির জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা হয়।
(iv) এই পদ্ধতিতে গণনা করার সময় দিনের চেয়ে রাত্রিকেই বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয় যাকে শুমারি রাত বলে।
(v) এই পদ্ধতিতে পরিবারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
B. বিধানত পদ্ধতি (Dejure Method) :
সংজ্ঞা বা (Definition):
কোন ব্যক্তি যেখানেই স্থায়ী বসবাস করে সেখান থেকেই তার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করার পদ্ধতিকে বিধানত পদ্ধতি বলে। ভারতবর্ষে এই পদ্ধতি থেকেই জনসংখ্যার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
• বৈশিষ্ট্য (Characteristics) :
(i) কোন ব্যক্তি যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে সেখানে থেকেই তাদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
(ii) এই পদ্ধতিতে কোন নির্দিষ্ট স্থানের প্রকৃত অধিবাসীকে বিবেচনা করা যায়।
(iii) এই পদ্ধতি পরিবার ও জনসংখ্যার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
(iv) এই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহর সময় নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়।
• আদমশুমারির গুরুত্ব ( Importance of Population Census) :
আদমশুমারি কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা ও আর্থসামাজিক অবস্থার সঠিক চিত্র তুলে ধরে। নিম্নে আদমশুমারির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল—
(i) জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন :
আদমশুমারির সাহায্যে কোন দেশে জননীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করে। জন্মনিয়ন্ত্রণ, শিশু সুরক্ষা, মহিলা সুরক্ষা, জন্ম, মৃত্যু, পরিযান সম্পর্কে বিশেষ তথ্য প্রদান করে।
(ii) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন :
আদমশুমারি পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পনা ছাড়া কোনো দেশেরই দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিকল্পনার জন্য সঠিক তথ্য প্রদান করে আদমশুমারি ।
(iii) জনমিতি (Demography) :
জনমিতি হল বিজ্ঞানের সেই শাখা যা মানুষের আকার বিবর্তন ও পরিমান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অধ্যায়ন করে। অর্থাৎ জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি অধ্যায়ন করাই হল জনমিতি। জনমিতি জন্মহার, মৃত্যুহার, পরিযান, পরিসংখ্যানগত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এই সকল তথ্য আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত হয়।
(iv) জনসংখ্যার কাঠামো :
জনসংখ্যার কাঠামো বয়স অনুসারে নারী পুরুষের অনুপাত ও তাদের গঠন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। এই জনসংখ্যার কাঠামো সংক্রান্ত তথ্য আদমশুমারি থেকেই সংগৃহীত হয়।
(v) জন্ম, মৃত্যু ও পরিযান সংক্রান্ত তথ্য :
জনসংখ্যা ভূগোলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল জন্ম, মৃত্যু ও পরিযান। এই জন্ম, মৃত্যু ও পরিযান সংক্রান্ত তথ্যগুি আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত হয়।
(vi) জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি :
কোন দেশের বা স্থানের জনসংখ্যার হ্রাস ও বৃদ্ধি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগৃহীত হয় আদমশুমারি থেকে যেমন 2011 সালে আদমশুমারি তে ভারতবর্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার 17.64%। ইহা আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত।
(viii) গ্রামীণ ও নগরীয় জনসংখ্যা :
আদমশুমারি থেকে গ্রামীন ও নগরীয় জনসংখ্যার বিভিন্ন দিক, যেমন—নগর ও গ্রামের শ্রেণীবিভাগ, নগর জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, বিকাশ, গ্রামীন জনসংখ্যার ধরন ও শ্রেণী প্রভৃতি বিষয়গুলি সহজেই জানা যায়।
(ix) জনসংখ্যার পেশাগত বন্টন :
জনসংখ্যার পেশাগত বন্টন, ধরন এবং কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা প্রভৃতি বিষয়গুলি আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত হয়।
(x) জনসংখ্যার অর্থনৈতিক কার্যাবলী :
জনসংখ্যার অর্থনৈতিক কার্যাবলী যেমন—প্রাথমিক কার্যাবলী (কৃষিকাজ), দ্বিতীয় কার্যাবলী (শিল্প) এবং তৃতীয় ও চতুর্থ কার্যাবলীর যাবতীয় তথ্য আদমশুমারি থেকে সংগৃহীত হয়।
Comments
Post a Comment