গ্রামীণ বসতির ধরণ বা বিন্যাস (The patterns of Rural Settlement of India)
গ্রামীণ বসতির ধরণ বা বিন্যাস
ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভৌগোলিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম অবদান রূপে ভারতের গ্রামগুলিতে গ্রামীণ স্তরে বাড়িগুলি সমাবেশ ও নানান বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতের গ্রামীণ বাড়িগুলির আঙ্গিক গঠনে এবং তাদের জ্যামিতিক বিন্যাসে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। ভারতের গ্রামগুলি অপরিকল্পিতভাবে এবং সুনির্দিষ্ট কোন আকৃতি ও অভ্যন্তরীণ বিন্যাসে কোন নির্দিষ্ট ছাদ ছাড়াই নির্মাণ করা হয় এবং স্থানীয় প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই ইহা বিস্তার লাভ ঘটে।
গ্রামগুলির বিন্যাসে পার্থক্য বিচারে ভারতের গ্রামগুলিতে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
1. আয়তাকার বিন্যাস (Rectangular Pattern):
ভারত কৃষিভিত্তিক দেশ, কৃষিকে কেন্দ্র করে গ্রাম গুলি গড়ে উঠেছে। নদী উপত্যকাগুলিতে কৃষিভিত্তিক গ্রামের সর্বাধিক সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। এখনাকার কৃষিজমিগুলির আকৃতি আয়তাকার হওয়ায় বসতিগুলিও আয়তাকার হয়। গ্রামের আকৃতি ভূমিরূপ, স্থানীয় সুযোগসুবিধার উপর নির্ভর করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ক্রান্তীয় অঞ্চলে ইহার আকৃতি বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তা লাভের আশায় মানুষজন পরস্পর সীমাবদ্ধ জমির উপর ঘরবাড়ি নির্মাণ
উদাহরণ: গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই ধনের বাড়িঘর এবং বসতি বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।
2. শূন্যগর্ভ আয়তাকার বিন্যাস (Hollow Roctangular Pattem ):
অতীতে যে সমস্ত অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকত কিংবা গ্রামের মধ্যভাগে স্থানীয় জমিদারদের প্রাসাদ ও দুর্গকে কেন্দ্র করে ফাঁকা আয়তকার বসতি গড়ে উঠে। আবার বসতির মাঝে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, মন্দির, মসজিদ, পুকুর অথবা ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ কে কেন্দ্র করে যে জনবসতি গড়ে ওঠে তাকে টাকা আয়তাকার জনবসতি বলে। রাজস্থানের মরু অঞ্চলের বসতিগুলি এই প্রকারের।
3. বর্গাকার গ্রামীণ বিন্যাস (Square Pattern)
এই ধরনের গ্রামগুলি গ্রামীণ পথের মিলনস্থলে গড়ে ওঠে। আবার * যেখানে পায়ে চলার পথ বা বড় রাস্তা পরস্পরকে আড়াআড়ি ভাবে অতিক্রম করে বিন্যস্ত থেকে সেখানে এস বসতি গড়ে ওঠে। এই বসতি আমকে চারটি ভাবে গ্রামকে বিভক্ত করে মধ্যভারতের গ্রামগুলিতে এখানে জাতপাতের প্রকোপ বেশি সেখানে এই ধরনের বসতি লক্ষ্য করা যায়।
4. শূন্যগর্ভ বর্গাকার বিন্যাস (Hollow Square Pattern):
শূন্যগর্ত আয়তাকার বিন্যাসের ন্যায় শূন্যগর্ভ বার্গক্ষেত্রের বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। শূন্যগর্ভ আয়তকার বসতির মতো এখানেও মাঝখানে ফাকাস্থানে, মন্দির, বাগান, জমিদারদের আবাস, মসজিদে থাকে।উদাহরণ—মালয় মালভূমি ও বুন্দেলগগুতে এই ধরনের গ্রামীন বসতি দেখা যায়।
5. রৈখিক বা দণ্ডাকৃতি বিন্যাস (Linear Settlement Pattern) :
এই ধরনের গ্রামগুলি একটি রাস্তা বা একাধিক রাস্তা অনুসরণ করে অথবা সড়কপথ, রেলপথ কিংবা নদীর ধারে সমান্তরালভাবে গড়ে ওঠে। এইরূপ গ্রাম বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বন্যার জলসীমার উপরে উচু ভূমি বরাবর নদীর বা স্বাভাবিক বাঁধ বরাবর এবং সমুদ্র উপকূলে এই ধরনের রৈখিক গ্রাম গড়ে ওঠে।
উদাহরণ—ভারতের গুজরাট, রাজস্থান, উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে গ্রামীণ পথের দুইধারে এই গ্রাম দেখা যায়।
6. দাবার ছকের ন্যায় বিন্যাস (Chess Board Pattern) :
বসতি বৃহৎ আয়তাকার বা বর্গাকার গ্রামে যদি গ্রামীণ পথগুলি প্রধান রাস্তা বা গলি রাস্তা একে অপরকে সমকোনে ছেদ করে প্রসারিত হয় তাহলে দাবার ছকের ন্যায় গ্রামীণ বসতির সৃষ্টি করে।এই ধরনের বসতিতে জনসাধারণ সামাজিক রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিগণ গ্রামের মাঝখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিগণ। ঠিক তার পাশে ও মিশ্র শ্রেণীর ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত বাহিরে বসবাস করে।
7. বৃত্তাকার বিন্যাস (Circular Pattern)
বৃত্তাকার ও সমকোণাকার বসতি পরস্পরের পরিপূরক। এই ধরনের বসতি কোন পাহাড়ী ঢিপি, জলাশয়, হ্রদ, বাগিচা ও কোন বস্তুর চারপাশে বা কোন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার সংযোগস্থলে বৃত্তকারে গড়ে ওঠে।
উদাহরণ: মধ্যযুগে দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উঃ পুঃ রাজস্থান, উচ্চগঙ্গা সমভূমি ও গুজরাট রাজ্যে ভূ-স্বামীদের বসতিকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বৃত্তাকার গ্রামগুর গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতের অনেক স্থানেই গোলাকার শৈলশিরা বা পাহাড়কে কেন্দ্র করে গোলাকার জনবসতি লক্ষ্য করা যায়।
৪. শূন্যগর্ভ বৃত্তাকার বিন্যাস (Hollow Circular Pattern)
শূন্যগর্ভ আয়তাকার ও বর্গাকার বিন্যাসের ন্যায় শূন্যগর্ভ বৃত্তাকার গ্রামীণ বিন্যাস উত্তর-পশ্চিম ভারতের নানা স্থানে দেখা যায়।
9 হেরিং মাছের কাঁটার ন্যায় বিন্যাস (Herring Bone Pattern)
এই শ্রেণীর বিন্যাস পাহাড়ী অঞ্চলে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।পার্বত্য অঞ্চলে একটি প্রধান গ্রামীণ পথের সঙ্গে অন্যান্য পথগুলি সুক্ষ্মকোণ মিলিত হলে এই পথগুলিকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে ওঠে, যা হেরিংমাছের কাঁটার ন্যায় দেখতে হয়।
10. পাখার ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট (Fan pattern)
এই ধরনের বসতি পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশের ও ব-দ্বীপ অঞ্চলে বাপলিগঠিত অঞ্চলে গড়ে ওঠে। কোন বিশেষ কেন্দ্রকে নির্দিষ্ট করে চারিদিক থেকে বিস্তার লাভ করে এই ধরনের বসতি গড়ে ওঠে।
উদাহরণ: মিশরের নীলনদ, ভারতের কৃষ্ণা ও তাবেরী নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে এইরূপ বসতি দেখা যায়।
II. টি ধরনের বসতি (T-Pattern Settlement)
যখন একটি রাস্তা অন্য একটি রাস্তার বিপরীত দিক থেকে এসে মিলিত হয় তখন সেই অঞ্চ রাস্তার ধার বরাবর যে বসতি গড়ে ওঠে তা "T" এর মতো দেখতে হয় বলে তাকে T আকৃতির জনবসতি বলে।
12. 'এল' ধরনের বসতি ('L Pattern Settlement)
কোন স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি 'L' আকৃতির হয় তখন L জনবসতি গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে 'L' আকৃতির বসতিগুলি ‘L আকৃতির মতো সমকোণে বিন্যস্ত হয়।
13. ত্রিভুজাকার ধরণ (Triangle Pattern)
কোনো ত্রিভুজের মতো বিস্তৃত রাস্তা বা বাজারকে কেন্দ্র করে যে বসতি গড়ে ওঠে তাকে ত্রিভূজাকৃতি বসছি বলে। এছাড়া দুটি নদীর মিলন স্থলে এই ধরনের বসতি গড়ে ওঠে।
14. তারকাকৃতি বসতি (Star Pattern) :
গ্রামীণ বসতিগুলি পায়ে চলার পথে বা রাস্তার এমন কয়েকটি দিকে বিস্তার লাভ করে যে গ্রামের আকার নক্ষত্রের মতো দেখতে হয়। নতুন নতুন বসতির বিন্যাস চারিদিকে বিস্তৃত হয় যার ফলে গ্রামীণ বসতির আকার নক্ষত্রের মতো হয়। এগুলি একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে, নদীর সংযোগস্থলে বা বাজারকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠতে পারে।
এছাড়াও শূন্যগর্ভ বিন্যাস বহুভূজাকৃতি, যমজ বিন্যাস, কেন্দ্রবিমুখ বিন্যাস, অর্ধবৃত্তাকার প্রবৃতি আকৃতির গ্রামীণ বসতি দেখা যায় ।
Comments
Post a Comment