কালাপাহাড় প্রবন্ধ: কালাপাহাড় গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।


কালাপাহাড় গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।


কালাপাহাড়’ - একটি পশু কেন্দ্রিক ছোটগল্পমানুষের সাথে অবলা প্রাণীর যে এটা নীরব অন্তরের সম্বন্ধ তিলে তিলে গড়ে ওঠে, তা এই গল্পটির মধ্যে দিয়ে বোঝা হবে। পশু হলেও তাদের মনে যে ভালবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা বিকাশ ঘটা সম্ভব তা এই কোটি পাঠ করলেই অনুধাবন করা যায়।

              প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘আদরিণী’র সাথে আমরা এই কলাপাহাড়’ গল্পটির বহুলাংশে সাদৃশ্য পাই। আবার শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ও ‘কালাপাহাড়ের অতুল। এই প্রত্যেকটি গল্পেরই কেন্দ্রে আছে একটি অবলা প্রাণী। যার সাথে তার মনিবের এক আত্মার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা অন্য জনের চোখে অদৃশ্য। চারপেয়ে প্রাণীটি কখন যে তার কর্তার সন্তানতুল্য হয়ে ওঠে, তা কেবল অন্তর্যামীই জানেন। তাই সেখানে হস্তরের আনন্দের কিংবা দুঃখের বহিঃপ্রকাশ কখনোও হৃদয়গ্রাহী আবার কখনো অতিরঞ্ছিত।

‘কালাপাহাড়’ গল্পের কেন্দ্রে আছে ‘কালাপাহাড়”। একটি অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের নেড়কে মোড়া এক অতিকায় দেব বিশিষ্ট মোষ। রংলাল গ্রামের অন্যান্য সকলের থেকে তলো গোরু কেনার উদ্দেশ্যে হাটে যায়। কিন্তু তার পছন্দ হয় দুটি মোষ। তাদেরই সে বাড়ি নিয়ে আসে। নামকরণ হয় –‘কালাপাহাড়’ আর কুম্ভকর্ণ। রংলাল সর্বদাই তার চাষের বিকে নিখুঁত থাকতে পছন্দ করতেন। তাই ক্ষেতে সবচেয়ে ভালো শক্তিমান পশুকে দিয়ে লঙ্ক দেওয়ালে যে ফলন নিঃসন্দেহে ভাল হবে, সেই আশা তার ছিল। তাই সে দুই শক্তিমান মোষকে বাড়িতে আনে। রংলালের আশাও পূরণ হয় – ‘মাঠে যখন সে লাঙল লায়, তখন প্রকান্ড বড় লাঙলখানা সজোরে মাটির বুকে চাপিয়া ধরে, কালাপাহাড় ও স্তকা অবলীলাক্রমে টানিয়া চলে, প্রকান্ড বড় বড় মাটির চাঁই দুই ধারে উল্টাইয়া পড়ে৷ এক হাতেরও উপর গভীর তলদেশ উন্মুক্ত হইয়া যায়। প্রকান্ড বড় গাড়িটায় একতলা ঘর সমান উঁচ করিয়া ধানের বোঝা চাপাইয়া দেয় –

         লোকে সবিষয়ে দেখে; রংলালহাস।

 মোষদটিকে নিয়ে সত্যিই রংলালের মনে মনে বেশ গর্ব ছিল। । । কিন্তু বাঘের সাথে লড়াইয়ে কুম্ভকর্ণের প্রাণপাত হলে রংলালের এই গর্বে ছেদ পাহাড়ের নেই।   নিরীহ কালাপাহাড় চিৎকার করে আর তার বন্ধুকে খোঁজে। কারণ মৃত্যুবোধ নিরীহ কালাপাহার নেই । সে শুধু তার বন্ধুকে পেতে চায়।এখানে গল্পের গতি পরিবাহিত পড়ে। হয়েছে কালাপাহাড়ের উপর নির্ভর করে। কালাপাহাড়ের কাজে মন নেই। রংলাল ব্যতীত অন্য কেউ তার কাছে গেলেই কালাপাহাড় তার মেজাজ হারায়। রংলাল ভাবে হয়তো সাথী নেই বলে কালাপাহাড় এমন করে। তাই রংলাল আরেকটি মোষ কিনে আনে।  তবে তা কালাপাহাড়ের তুলনায় কনিষ্ঠ। তাকে দেখা মাত্রই কালাপাহাড় রাগে ফুঁসতে থাকে। রংলালের অনুপস্থিতিতে কালাপাহাড় নতুন মোষটিকে মৃতপ্রায় করে ফেলে। 

                  শেষপর্যন্ত রংলাল তার ছেলে যশোদানন্দনের পরামর্শ মানতে বাধ্য হয় এবং কালাপাহাড়কে বিক্রি করতে রাজি হয়। কিন্তু কালাপাহাড় তার আরেক সস্তাসম। তাই যশোদার কথায় রাজি হলেও মনে মনে রংলাল বেদনাশ্রু ঝরিয়াছে। শেষ পর্যন্ত রংলাল কালাপাহাড়কে হাটে বিক্রি করে আসে। কিন্তু কালাপাহাড় রংলাল ব্যতীত অন্য কাউকে চেনেনা। তাই সে চিৎকার করে রংলালকে খুঁজতে থাকে।নতুন মালিকের বারণ উপেক্ষা করে সে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুলিসের গুলিতে কালাপাহাড়ের মৃত্যু হয়।

         অন্যান্য সকলের চোখে বোঝা কিংবা অস্বস্তির কারণ হলেও রংলালের কাছে কালাপাহাড় এক রত্নসম। তাকে ঘিরেই রংলালের দিন কাটছে। সময় গিয়েছে তার সাথে গল্প করতে করতে। সেই সাথে গল্পের কাহিনীকে চালিত করার ক্ষেত্রে কালাপাহাড়ের ভূমিকা মুখ্য। বাস্তব জীবনে আমরা যেমন আমাদের বাড়ির যে কোনো পোষ্যের সাথে আন্তরিক ভাবে মিশতে ভালবাসি, তাকে পছন্দ করি, শাসন করি, সে যেমন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে, তেমনই কালাপাহাড়ও রংলালের জীবনে প্রাধান্য পেয়েছে। সে হয়ে উঠেছে রংলালের পরিবারের একজন সদস্য। তাই বলা যায় সর্বোত ভাবেই এই গল্পের নামকরণটি যথাযথ ও যুক্তিযুক্ত।

Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)