রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার কর ?

 প্র: রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার কর ?

উ: কবিতার নামকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই নামকরণ। করা হয়। যেমন—বিষয়বস্তু অনুসারে, কোন চরিত্রের নাম অনুসারে, কিংবা ভাবব্যগ্লুনা বা ভাবসত্যের অভিব্যক্তি অনুসারে নামকরণ করা হয়ে থাকে। তাই নামকরণথেকেই বোঝা যায় যে কবি কীভাবে নামকরণ করেছেন। এছাড়া আর একটা দিক স্পষ্ট হয় যে কবিতার বিষয়বস্তু কী হতে পারে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ নামকরণ কবিতার একটা আলোক শিখাও বটে। রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটির নামকরণ কতখানি সার্থক তার বিচার দরকার।

‘নির্ঝর’ শব্দের সাধারণ অর্থ ‘ঝরনা’ বা ‘পাহাড়ি জলধারা'। এই ঝরনা বা পাহাড়ি জলধারা আপন গতিতে চলে—অবিরাম তার গতিধারা। এই জলধারা একসময় গতানুগতিকতায় পরিণত হয়। ছকে বাঁধা জীবনে পরিণত হয়। জীবন হয় অবরুদ্ধ। বাঁধা জীবন বন্দিদশা প্রাপ্ত হয়। কবির মনে হয় এ জীবন যেন পাষাণ কারাগারে বন্দির মতো। এ এক অন্ধকার গুহার মতো—যেখানে বাইরের জীবনের কোনো সম্পর্ক থাকে না। জগতের কোনো আলো পৌঁছোয় না।

কিন্তু এই ‘নির্ঝরের’ একদিন ‘স্বপ্ন ভঙ্গ’ হয়; নিদ্রা দশা ঘুচে গিয়ে ‘জাগরণ’ ঘটে। ‘প্রভাত রবির কর’ এবং ‘প্রভাতি পাখির গানে কবির চেতনার দ্বার খুলে যায়। পাষাণ-কারা ভেঙে কবি বেরিয়ে আসতে চান বাইরের আলোর জগতে। অন্ধকার গুহাভ্যস্তরে তাঁর প্রাণ রুদ্ধ হয়ে আছে—তাকে মুক্তির আঙিনায় আনতে কবিহৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তিনি যেন প্রাণ খুলে বেরিয়ে আসতে পারছেন। তাই তিনি বলেছেন—

        ‘এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ, 

         এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।'

তাই প্রাণের আবেগ, প্রাণের বাসনা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রবল বেগে মুক্ত ঝরনার জল যেমন প্রবাহিত হয় তেমনি কবিও বাইরে বেরিয়ে আসতে চান। কবির ভাষায়—

        ‘বাহিরিতে চায়,     দেখিতে না পায় 

                 কোথায় কারার দ্বার।'

কারণ তিনি কারামুক্ত হয়েছেন, গুহামুক্ত হয়েছেন— এখন তিনি আলোর জগতে চলে এসেছেন। নিদ্রামুক্ত হয়ে জাগরণ অবস্থায় উপনীত হয়েছেন—‘জাগিয়া উঠেছেপ্রাণ।' সেখানে তিনি প্রাণ ঢেলে দেবেন, সাধ-বাসনা চরিতার্থ করবেন। তিনি প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চান। কবি সত্তা আর বিশ্বসত্তা যেন একাত্ম হয়ে উঠছে এই উন্মুক্ত জাগরণে। বিশ্বচরাচর তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে। তিনি তাঁর মধ্যে নিজেকে মেলে ধরেছেন—প্রাণের আবেগ ঢেলে দিয়েছেন।

          সুতরাং ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার নামকরণ অতীব সার্থক। কবিতাটি রূপক ও ব্যঞ্ঝনাত্মক। এটি রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার মোড় ঘুরানো উপলব্ধির কবিতা। জাগরণের কবিতা। নিদ্রাভঙ্গের কবিতা। সুপ্ত অবস্থা থেকে মুক্ত অবস্থায় উপনীত হওয়ার কবিতা। তাই বলা যায় কবিতাটির নামকরণ যথার্থ ও সার্থক।





Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)