জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কিত ম্যালথাসের তত্ত্ব (The Malthusian theory of Population Growth)

Content

ভূমিকা (Introduction)

ম্যালথাসের তত্ত্বের মূল বক্তব্য (Main Concept of Malthusian Theory

ম্যালথাসের তত্ত্বের ব্যাখা (Explanation of Malthusian Theory)

ম্যালথাসের তত্ত্বের সমালোচনা/ত্রুটি (Criticisms of Malthusian Theory)

ম্যালথাসের তত্ত্বের গুরুত্ব/মূল্যায়ন (Importance or Evaluation of Malthus Theory) 

➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖

 ■ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কিত ম্যালথাসের তত্ত্ব (The Malthusian theory of Population Growth) :


• ভূমিকা (Introduction) :

Malthus, Karl Marx, Adam Smith প্রমুখ চিন্তাবিদগণ অষ্টাদশ শতাব্দীরতে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন । তবে তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন ম্যালথাস (T.R.Malthus)। থমাস রবার্ট ম্যালথাস হলেন একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। ম্যালথাস 1766 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এবং 1834 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ম্যালথাস কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন Jesus College-এ পড়াশোনা করেন। ম্যালথাসের পিতামাতা ছিলেন উদার। থমাস রবার্ট ম্যালথাসের পিতা থমাস ডেনিয়েল ম্যালথাস ছিলেন পেশায় একজন উকিল। তৎকালীন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ডেভিড ঝুম ও রুশোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। ম্যালথাস তার পিতামাতার কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কেম্ব্রিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে ম্যালথাস ধর্মশিক্ষা শুরু করেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর রবার্ট ম্যালথাস নিজের জন্মস্থানের এক গির্জায় কাজ শুরু করেন ও শীঘ্রই পাদরি হয়ে যান। 1804 খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ম্যালথাস বিবাহ করেন এবং ম্যালথাসের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখী। বিবাহের পরবর্তীকালে ম্যালথাস History and Political Economy-এর অধ্যাপক হিসাবে East India College -এর Hailey Bury College -এ যোগদান করেন। T. R. Malthus 1798 খ্রিস্টাব্দে তাঁর “An Essay on the Principle of Population’ গ্রন্থে তিনি জনসংখ্যা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাধারা তুলে ধরেন। ‘তার জনসংখ্যা বিষয়ক বিখ্যাত বইটি ছিল দুটি খণ্ডে বিভক্ত। 1798 খ্রিস্টাব্দে এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গে এই বইটি সমস্ত মহলে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এবং এর ফলে পুস্তকটির কলেবর উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এই বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় 1803 সালে। এই গ্রন্থে তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত এক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। 1798 খ্রিস্টাব্দে জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক যে বক্তব্য T.R. Malthus প্রদান করেন তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বা ম্যালথাসীয় জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে বিবেচিত। ম্যালথাসের তত্ত্বকে অনেকেই জনসংখ্যার জৈবিক ও সামাজিক তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করেন।


ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের মূল বক্তব্য (Main Concept of Malthusian Theory) :


ম্যালথাস তাঁর গ্রন্থ ‘An Essay on the Principle of Population", এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত এক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ম্যালথাস মানব সম্পদকে দুটি উপাদানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেন যথা—জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগান। ম্যালথাসের তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল–জনসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় জ্যামিতির হারে বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে জীবনধারনের উপকরণ খাদ্যের জোগান বৃদ্ধি পাবে গাণিতিক হারে। তার মতে গুণোত্তর হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে কিন্তু খাদ্যের জোগান সমান্তরাল হারে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগান বৃদ্ধি কখনই সমান হবে না। সেই কারণেই ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের চাহিদা ও খাদ্যের যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য কখনও থাকবে না ফলে খাদ্য সমস্যা অনিবার্য। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বে খাদ্যের জোগান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ হিসাবে দেখানো যায় যে—



ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের ব্যাখা (Explanation of Malthusian Theory) :


ম্যালথাস মানবসম্পদকে দুই উপাদানের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করেছেন, যথা জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগান। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বে খাদ্যের জোগান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন-----


i) জনসংখ্যার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি :

সুষ্ঠু পরিবেশে মানব সমাজের প্রজনন ক্ষমতা ও প্রজনন সম্ভাবনা অন্যান্য প্রাণীর মতো খুবই বেশি। ম্যালথাসের মতে মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষনভাব জাগরিত হয় এবং স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানোৎপাদন প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়। এবং এই প্রজনন ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত। ম্যালথাসের মতে এই প্রজনন ক্ষমতা কোনো বাধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না করতে পারলে তবে তা গুণিতক হারে (1:2:4:8:16:32:64:128 ইত্যাদি) বৃদ্ধি পাবে। ম্যালথাসের মতে কোনো রকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা অভাবে এই জনসংখ্যা 25 বছরে দ্বিগুণ হবে। এবং এই ধারা বজায় থাকলে তবে 200 বছরে জনসংখ্যা 256 গুণ বৃদ্ধি পাবে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ—“Prosperity was not depend on population but population was to depend on prosperity."


ii) খাদ্যের গাণিতিক হারে বৃদ্ধি :

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। ম্যালথাসের মতে কোনো দেশের জনসংখ্যার আকার সেই দেশের পদার্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে খাদ্যের উৎপাদন কিংবা যোগান পরিমান সীমিত। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যোভাব সৃষ্টি হয়। খাদ্যের জোগান জনসংখ্যার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের জোগানের উপর টান পড়বে। ম্যালথাসের মতে খাদ্যবস্তুর বৃদ্ধি গাণিতিক অনুপাতে (1:2:3:4:5:6:7:8) হয়। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর হারে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের অভাব দেখা যায়। এছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান প্রতিদানের নিয়ম কার্যকরী হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের একটি সীমার পর হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়।


         ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা তীব্রগতিতে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় কিন্তু খাদ্যসামগ্রী গাণিতিকহারে বৃদ্ধি পায় জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রতিবন্ধকতা বা নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে যাবে। ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা ও দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তা কয়েক শতাব্দীর পরে ভীষণ রকম বাড়বে। কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মেনে নেননি তাই তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য কতকগুলি ব্যবস্থার কথা বলেন। যথা—


(i) অনিবার্য ব্যবস্থা (Positive Check)


(ii) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (Preventive Check)


(i) অনিবার্য ব্যবস্থা (Positive Check) :

কিছু ঘটনা এমন আছে যেগুলি প্রকৃতিতে অনিবার্যভাবে ঘটে থাকে যা জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি দুর্যোগ জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্ধিত জনসংখ্যা কমে গেলে জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগানের মধ্যে সমতা স্থাপন হয় কিন্তু এই সমতা খুবই অল্প সময়ের জন্য হয় কারণ মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ক্রিয়াশীল হলে জনসংখ্যা আবার দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং কয়েক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা খাদ্যের জোগানের তুলনায় পুনরায় বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে মৃত্যুহার বেড়ে যায় ফলে জনসংখ্যা কম হয়।


(ii) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (Preventive Check) :

এক্ষেত্রে ম্যালথাস মানুষের নিজস্ব চারিত্রিক কারণকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে মানুষের কাছে কষ্টদায়ক। তাই তিনি বলেন যে মানুষ যদি প্রতিবন্ধক পদ্ধতির সাহায্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবে তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাকে বাঁচাতে পারে। তিনি আরও বলেন যে মানুষের প্রতিবন্ধকের এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত যাতে এমন অবস্থার সৃষ্টি না হয় যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রকৃতিকে আবার সচেষ্ট হতে হয়।


ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে পাপ কাজ বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ, উন্নতর জীবনযাত্রা প্রভৃতি মানুষের জন্ম নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী হবে। ম্যালথাস আত্মসংযমকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রধান ও প্রভাবশালী উপাদান বলে মনে করতেন। প্রতিবন্ধক নিয়ন্ত্রণ অর্থে তিনি বলেন যে আত্মসংযম, ব্রহ্মচর্য পালন, বিবাহ না করা বা দেরি করে বিবাহ করা ইত্যাদি।


ম্যালথাস জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা বললেও তিনি মানুষের দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী ছিলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্যের জোগান অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হবে সামাজিক বিপর্যয়।


ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের সমালোচনা/ত্রুটি (Criticisms of Malthusian Theory) : 

ম্যালথাসের ভবিষ্যৎবাণী অর্থনৈতিক জগতে যে বিতর্কের সৃষ্টি করে তার মীমাংসা এখনও হয়নি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে ম্যালথাসের তত্ত্ব হতাশা ও নৈরাশ্য পীড়িত। কারণ তারা মনে করেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং মানুষ যেহেতু বুদ্ধিমান জীব তাই খাদ্যের সমস্যার সৃষ্টি হলে মানুষ তার উন্নততর বুদ্ধির সাহায্যে সেই সমস্যার সমাধান করবে। তাদের মতে মূল সমস্যা খাদ্যের উৎপাদন নয় খাদ্যের বন্টন ব্যবস্থা। ম্যালথাসের তত্ত্বের প্রধান ত্রুটিগুলি হলো -


i) পাটীগাণিতিক হারে খাদ্য উৎপাদন অথচ জ্যামিতিকহারে জনসংখ্যা বাড়ছে ম্যালথাসের এই অভিমত তাঁর পরবর্তী সময়ে বিশ্বের কোনো দেশেই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়নি। জনবিজ্ঞানী K. Smith এর মতে এসব অনুপাতের কোথাও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।


ii) কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি থাকতে পারে। ঐদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবনতির বদলে আরও উন্নতি হতে পারে তা ম্যালথাস বলেননি।


iii) ম্যালথাস কৃষি প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট কারিগরী বিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বিষয়টি চিন্তা করেননি। ফলে যন্ত্রপাতি ব্যবহার, জলসেচের সুবিধা, সার ও কীটনাশক ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমেও যে খাদ্যের যোগান বাড়ানো যায়, সেই সম্পর্কে ম্যালথাস নীরব থেকেছেন।


iv) প্রাণীজগতে সংখ্যা বৃদ্ধির একটি জৈবিক বা জীববিজ্ঞান ভিত্তিক সীমা আছে। প্রাণীজগতে অন্যতম সদস্য হল মানুষ। সুতরাং সংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্নে মানুষের ক্ষেত্রে একই জৈবিক শর্ত অনুসৃত হবে—এটাই স্বাভাবিক। v) শিল্পজাত দ্রব্যের বিনিময়ে বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা যায় যা ম্যালথাস বিবেচনা করেননি।


vi) ম্যালথাসের মতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা তথা শ্রমের যোগান মানুষের দুঃখদুর্দশার মূল কারণ। কিন্তু মানুষের জীবন যাত্রা এবং জীবনধারনের উপাদান শ্রমের যোগান নয়, বরং উপর নির্ভরশীল।


vii) মানুষ শুধু ভোগের জন্য জন্মগ্রহণ করে না। কাজের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, স্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সাথে সাথে জন্মহার কমে যায়।


viii) ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা জ্যামিতিকহারে বাড়বে। এর ফলে অচিরেই খাদ্য সমস্যা সহ জীবনযাত্রার মান কমবে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের কতিপয় দেশের উৎপাদন জনসংখ্যাকে অতিক্রম করে।


ix) প্রজনন ক্ষমতা ও প্রজননশীলতা দুটি ভিন্ন বিষয়। ম্যালথাস এদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য টানতে পারেননি। ফলে তিনি প্রজননের দৈহিক ক্ষমতা এবং প্রকৃত প্রজননের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরতে পারেননি। তাই প্রতি 25 বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে—তার এই বক্তব্য সত্য নয়।


x) ম্যলাথাস উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধির উপর ভিত্তি করে তার মতবাদ প্রচার করেন। বর্তমানকালের বৈজ্ঞানিক কৃষি পদ্ধতির কথা তার অজানা ছিল। ফলে তার তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে অনেক দেশে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।



ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের গুরুত্ব/মূল্যায়ন (Importance or Evaluation of Malthus Theory) :


ম্যালথাসের তত্ত্বের তীব্রভাবে সমালোচনার সত্ত্বেও তা আজও স্থির ও অবিচল হয়ে রয়েছে। মার্শাল, কোসা প্রমুখ অনেক অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের তত্ত্ব সমর্থন করেছেন। সুখ ও সমৃদ্ধির দিনে আমরা ম্যালথাসকে ভুলে থাকতে পারি কিন্তু যখনই খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য সরবরাহের অনিশ্চয়তা ফিরে আসে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তখনই আমরা ম্যালথাসকে স্মরণ করি তার সাবধানবাণী আমাদের দ্রুত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে প্ররোচিত করে। যখন ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ব্যবধান বিপজ্জনক সীমার কাছাকাছি এসে যাবে তখনই ম্যাল এর সূত্রের কার্যকারিতা লাভ করবে। ম্যালথাসের তত্ত্বের মধ্যে যে সত্যতা নিহিত আছে আমরা তা অস্বীকার করছে পারি না। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের গুরুত্বগুলি হল—


i) আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষের উপর ম্যালথাসের সতর্কতার গভীর প্রভাব পড়েছে। সম্ভবত সেই কারণে সেখানকার মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম পদ্ধতির অধিক ব্যবহার করে যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত মৃদু বা স্থির হয়ে থাকে।


ii) যখন কোনো দেশে জনসংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে ভূমিসমস্যা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তখন ব্যক্তি প্রতি আয় কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্রতা, বেকারত্ব, অনাহার ইত্যাদি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় যা নিবারণের জন্য জনসংখ্যার হ্রাসই একমাত্র পথ কারণ ভূমি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যালথাসের তত্ত্ব বেশি সঠিক বলে মনে হয়।


in) ম্যালথাসের বক্তব্য ছিল যে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রক ব্যবহার না করলে জনসংখ্যা গুণিতক হারে (তীব্রগতিতে বাড়তে থাকবে—একথা মিথ্যা নয়। পাশ্চাত্য দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণ কৃত্রিম প্রতিরোধ ব্যবহার।


iv) ম্যালথাসই প্রথম যিনি জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কেমন করে রোধ করা যেতে পারে সে বিষয়ে সুদৃঢ় মতামত প্রকাশ। করেন। জন্মহার নিয়ন্ত্রণে প্রতিষেধক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা তিনিই প্রথম বলেন।


v) ম্যালথাসের চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়ে অর্থনীতি ও জীববিদ্যার ওপর। তিনি বলেন, শ্রমিকের জোগান যখনই কমে, শ্রমমূল্য তখনই ঊর্ধ্বগামী হয়। অধিক উপার্জন জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়, শ্রমবাজারে অশুভ প্রতিযোগিতা, শ্রমমূল্য হ্রাস। সেইজন্যই দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণি কখনই তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন ন


vi) আধুনিক অর্থশাস্ত্রের ভিত্তিই হল ম্যালথাসের তত্ত্ব। তাঁর মতে, “এ তত্ত্বকে বলা যেতে পারে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার আরোহ অনুমান পদ্ধতির প্রথম সার্বিক প্রয়োগ।”


vii) আর্থিকভাবে অগ্রসর দেশগুলিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম পদ্ধতির কথা ব্যবহারের ফলে জন্ম হার উচ্চ হয়। জনসংখ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বারংবার প্রাকৃতিক প্রকোপের ভয়ংকরতার ফলে মৃত্যুহারও বেশি হয়। এ থেকে ম্যালথাসে এই ভাবনাও সত্য হয় যে জনসংখ্যা ও খাদ্য পূরণের জন্য অসমতা হলে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক কার্যকরী হয়ে ওঠে।


viii) জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্ব, দারিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, চুরি ইত্যাদি বৃদ্ধির সতর্কতা দিয়েছেন ম্যালঘর যা উন্নয়নশীল দেশগুলির পটভূমিকায় অনেকাংশে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এইসব দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে।





Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)