বিশ্ব উষ্ণায়ন কাকে বলে?,বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ ও প্রভাব আলোচনা কর,

[Note- Please join our Facebook page for any important notification--- ]


 বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming)

আধুনিক বিশ্বে যান্ত্রিক সভ্যতা অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অবিবেচনা প্রসূত কার্যকলাপের ফলে তৈরি হচ্ছে নানান ধরনের বিষাক্ত গ্যাস। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলি পৃথিবীতে নিয়ে আসছে এক ধরনের ভয়ঙ্করতম পরিবেশ গত বিপর্যয় ‘Global Warming” । যা মানুষ তথা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) এর ফলে পৃথিবীর গড় উত্তাপ বাড়বে 5.8°C। সমুদ্র জলের উচ্চতা বাড়বে 15-95 cm (2050 সালে), হিমবাহের গলন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে, বাংলাদেশের 17% ভূমি যাবে। সমুদ্রের জলের তলায় (2030 সালে)। এই হারে তাপমাত্রা বাড়লে তলিয়ে যাবে ভারতের 5763 বর্গকিমি উপকূলবর্তী অঞ্চল, মহাপ্লাবন ও খরা সৃষ্টি হবে ডুবে যাবে কলকাতা, মুম্বাই, লন্ডন, নিউইয়র্ক, মালদ্বীপ, মরিশাস, সুন্দরবন। শুকিয়ে যাবে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র ও সিন্ধুর উৎসমুখ। তৈরি হবে নতুন সমস্যা‘Environmental Refugee"। ভারতের GDP 5% হ্রাস পাবে, ভূ-গর্ভস্থ জল নেমে যাবে, প্রতি 1° উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ধান ও গম উৎপাদন হ্রাস পাবে 10%, মহামারি ও রোগের প্রবণতা বাড়বে, 2075 সালে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর অনেক জৈব বৈচিত্র্য।


বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) :

সূর্যরশ্মি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ক্ষুদ্র তরঙ্গ রূপে পৃথিবীতে আসে কিন্তু বায়ুমণ্ডলে গ্রীণ হাউস গ্যাস (CO., Co. CFC, O,, CH,, N,O, H,O, SO,) গুলির পরিমাণ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বৃহৎ তরঙ্গরূপে যেতে পারে না, পুনরায় ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসে এবং বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তোলে। পৃথিবী জুড়ে উষ্ণতার এই বৃদ্ধিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming)বলে।

Savindra Singh এর মতে- "Global Warming refers to gradual in atmospheric and ground surface an temperatures and consequent changes in global radiation balance caused mainly anthropogenic processess leading to climatic changes at different levels (Local, Regional and global levels)



বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ (Causes of Global Warming)

গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলিই মূলত বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানী দহন, বৃক্ষ নিধন, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পায়ন, নগরায়ন ও পচা জৈব আবর্জনা ও CFC গ্যাসই মূলত বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। নিম্নে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণগুলি আলোচনা করা হল।


1. জীবাশ্ম জ্বালানীর অতিরিক্ত ব্যবহার :

 জীবাশ্ম জ্বালানী (খনিজ তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস) অবাধ ও অতি ব্যবহারের ফলে প্রচুর পরিমাণে CO, বায়ুমণ্ডলে মিশছে। ক্রমবর্ধমান জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের ফলে 1860-2005 সালের মধ্যে CO, এর পরিমাণ বেড়েছে প্রায় 31% (290-365PPM)। এই হারে ব্যবহার করলে 2030-2050 সালে CO, পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। বায়ুমণ্ডলে প্রতি বছর 9 বিলিয়ন টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে মিশছে। জীবাশ্ম জ্বালানী দহনের ফলে তৈরি হয় CH, ও N O গ্যাস। 1 কেজি মিথেন গ্যাস যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে তা 25 kg Co. র সমান। আবার 1kg NH, যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে তা 300 kg CO/র সমান।

2. শিল্পায়ন : 

মূলত শিল্প বিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। শিল্পায়নের ফলে বিশাল পরিমাণ গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলি বায়ুমণ্ডলে মিশছে। 1850 সালে কাঠ কয়লা ও তৈল পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হত 3 বিলিয়ন টন। আর 2000 সালে আমরা শুধু কয়লা পুড়িয়ে তৈরি করেছি 7 বিলিয়ন টন Co.। বিপ্লব অর্থাৎ 1850 সালের পর থেকে বাতাসে CO, এর পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে এর প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে 074°C । গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে শেষ 50 বছর ছিল উষ্ণতম। 1999 সালে একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যত পরিমাণ CO, বায়ুমণ্ডলে মিশেছে তার 50% নিঃসরণ ঘটাচ্ছে বিশ্বের প্রধান ৪টি দেশ। ভারতের মানুষ মাথাপিছু যেখানে বছরে মাত্র 1 টন CO, বায়ুমণ্ডলে মেশায় সেই জায়গায় আমেরিকানরা বাতাসে CO,মেশায় বছরে 19 টন।


3. নগরায়ন :

 নগরায়নের ফলে গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলির মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার ফলে প্রচুর পরিমাণে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়াও শহরের জঞ্জাল থেকে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত CH, গ্যাস, যানবাহন ও রান্নার অন্যান্য কাজকর্মের ফলে তৈরি হচ্ছে CO., CH, N.O, CFCS প্রভৃতি গ্যাস। AC মেশিন (2.5 টন) এর জেনারেটর থেকে তৈরি হয় 3কেজি. CO, প্রতি ঘণ্টায়। এছাড়াও প্রতি ঘণ্টায় মাইক্রোওভেন এর জন্য জেনারেটর তৈরি করে 1.3 kg CO,I


4. যানবাহনের ধোঁয়া:-

 বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বিশেষ দায়ী যানবাহনের ধোঁয়া। এই ধোঁয়াতেই রয়েছে বিষাক্ত গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলি। একজন ভারতীয় এক বছরে যে পরিমাণ CO, উৎপাদন করে, তা একজন ব্যক্তি এক ঘণ্টা প্লেনে ভ্রমণ করে সেই পরিমাণ CO, উৎপন্ন করে। পরিবহনের ধোঁয়া বা শিল্পায়নের ধোঁয়ায় সৃষ্টি হয় Smog যা বিশ্ব উষ্ণায়নে সাহায্য করে। যানবাহনে ব্যবহৃত । লিটার পেট্রোল পুড়িয়ে তৈরি হয় 1kg জলীয় বাষ্প এবং 2.77 kg CO। আমরা যদি সপ্তাহে 2 লিটার পেট্রোল বাঁচাতে পারি তাহলে প্রতি 22568 kg CO, নিঃসরণ বন্ধ হবে বায়ুমণ্ডলে প্রতিবছর। কোন গাড়ি 6 কিমি পথ গেলে 1কেজি CO, বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ করে।


5. বনভূমি ধ্বংস : বনভূমি ধ্বংসের ফলে গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলির মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে প্রধান গ্রীণ হাউস গ্যাস CO, শোষণ করতে পারে উদ্ভিদ।অরণাচ্ছেদনের ফলে CO, এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যেক বছর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে 20 মিলিয়ন হেক্টর অরণ্য যা আয়তনে বেলজিয়াম রাষ্ট্রের 7 গুণের সমান। মারাত্মক পরিসংখ্যান হল এটি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের অরণ্য আমরা ধ্বংস করে চলেছি প্রতি মিনিটে। প্রত্যেক বছর একটি গাছ 12 kg CO, গ্রহণ করতে পারে এবং 4 জন মানুষের অক্সিজেন দিতে পারে। পৃথিবীতে 200,000 একর বৃষ্টি অরণ্য পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে প্রতিদিন। এই হারে চলতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবী থেকে বৃষ্টি অরণ্য বিলীন হয়ে যাবে। নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি বাৎসরিক 2 বিলিয়ন টন CO, গ্রহণ করে, তাও প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে। গত 50 বছরে আমাজন অরণ্যের 20% বনভূমিকে বিনষ্ট করে দেওয়া


6. জীবের পচন : 

শহরের পচা, আবর্জনা, কৃষি আবর্জনা, উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ এইসব পচা জৈব আবর্জনাগুলি থেকে তৈরি হয় বিষাক্ত CH, গ্যাস, যা বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করতে সাহায্য করে। গত 150 বছরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে CH, (149%) গ্যাস। 1kg মিথেন থেকে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় 25 kg CO, তাপ উৎপন্ন হয়। পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মিথেনের ভূমিকা 18%। থেকে সমপরিমাণ


7. অত্যধিক হ্যালন গ্যাসের ব্যবহার :

 রেফ্রিজারেটর ও AC মেশিন, ফোম, স্পেক্যান, রং প্রভৃতি তৈরিতে CFC গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এই CFC গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে CFC

8. তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র : 

তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলিতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সময় প্রচুর পরিমাণে ছাই, ধোঁয়া, CO, CO., NH, N.O, SO, বায়ুমণ্ডলে মিশে Green House গ্যাসগুলিকে বাড়িয়ে তুলেছে। আর এই গ্রীণহাউস গ্যাসগুলি পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। উল্লেখ্য একটি 1000MW ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বাৎসরিক প্রায় 7 মিলিয়ন টন CO, নিক্ষিপ্ত হয় (কয়লা পুড়ে 3.8 মিলিয়ন টন)।


9. কৃষিকার্যে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক :

 কৃষিকার্যে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ঔষধ যেমন DDT, DDPV, HCH, DBCP ও PAN এবং 10CV প্রভৃতি। এছাড়াও সালফার ডাইঅক্সাইড ও নানা ধরনের সার থেকে CH,, N,O, NH, প্রভৃতি উৎপন্ন হয় কৃষি প্রক্রিয়া থেকে। তাছাড়াও কৃষি আবর্জনা থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নির্গত হয় মিথেন গ্যাস, যা ভুবন উষ্ণায়নে বিশেষ সাহায্য করে।


বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব (Effects of Global Warming) :

পৃথিবী উত্তপ্ত হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয় গলবে হিমবাহ, শুকিয়ে যাবে সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীর উৎসমুখ, সমুদ্রের জল বাড়বে, চিরতরে ডুবে যাবে দ্বীপরাষ্ট্রগুলি তৈরি হবে নতুন সমস্যা 'Environmental Refugee | পানীয় জলের সমস্যা বৃদ্ধি পাবে বাড়বে সমুদ্র জলের অম্লতা।দেখা দেবে মহাপ্লাবন, মহামারী ও নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়। হয়তো মানুষের অস্তিত্ব একদিন বিলীন হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে জৈব বৈচিত্র্য। নিম্নে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবগুলি আলোচনা করা হল।।

 1. হিমবাহের গলন :

 এইভাবে গ্রীণ হাউসগুলি নিঃসরণ হলে পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হবে আর গলবে হিমবাহ। আগামী 100 বছরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা 3°C-7°C পর্যন্ত বেড়ে যাবে। ভূবন উষ্ণায়নের ফলে 1910 সালে তৈরি মন্টনার মেসিয়াল ন্যাশানাল পার্কে প্রায় 150টি হিমবাহ ছিল তা এখন কমে হয়েছে 30এর কম। 1912 সাল থেকে তানজানিয়ার মাউন্ট কিলিমাঞ্জরোর বরফ প্রায় ৪০% গলেছে। পৃথিবীর উষ্ণতা 2°C বাড়লে গ্রীণল্যান্ডের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর 7 মিটার বাড়িয়ে দেবে। 2040 সালের মধ্যে গ্রীষ্ম পরবর্তী সময়কালে সুমেরুর বরফ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতি বছর নতুন বরফ তৈরি হওয়ার আগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বরফ ঢাকা অঞ্চলের আয়তন এতদিন ছিল 5.9 মিলিয়ন বর্গকিমি.মাত্র এক দশকের মধ্যে বিশাল বরফ সাম্রাজ্যের আয়তন কমে দাঁড়িয়েছে 1.9 মিলিয়ন বর্গকিমি.। বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) এর ফলে বছরে 10-15 মিটার করে কমছে বড় হিমবাহগুলি। গঙ্গোত্রী হিমবাহ হ্রাস পাচ্ছে প্রতি বছর 23 মিটার করে। কানাডা, আলাস্কা ও রাশিয়ায় ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চলগুলিতে দ্রুত বরফ গলছে।

 2. সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি : 

ভূবন উষ্ণায়নের ফলে গলছে হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্রের জলের উচ্চতা, ফলে ডুবে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রগুলি। তাপমাত্রা 1.5-4.500 পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে 15-95 সেমি। আগামী 2030-2050 সালের মধ্যে দৈনিক গড় তাপমাত্রা 200-500 বৃদ্ধি পাবে। তারফলে 2050 সালের মধ্যে সমুদ্রতল 50 100 সেমি বাড়বে এবং একবিংশ শতাব্দীর শেষে সমুদ্র জলতল বাড়বে প্রায় 180-200 সেমি। গত শতাব্দীতে সামুদ্রিক ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জলের উচ্চতা প্রায় 16.5 সেমি বেড়েছে। প্রতি বছর সমুদ্র জলের উচ্চতা বাড়ছে প্রায় 2মিমি.।সুন্দরবনের 120টি দ্বীপের মধ্যে ঘোড়ামারা দ্বীপের দক্ষিণে লোহাচর ও সুপারি ডাঙা দ্বীপ চলে গিয়েছে জলের তলায়।2070 সালে সমুদ্র জলের উচ্চতা বাড়বে 50 সেমি ডুবে যাবে সুন্দরবন, বকখালি, দীঘা, শঙ্করপুর, তালসারি, বিচিত্রপুর,মান্দারমনি, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস তলিয়ে দেবে কলকাতাকে। 

3. ডুবে যাবে দ্বীপরাষ্ট্র:

 গত একশো বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে 0.6°C। চলতি শতকের শেষে তা বেড়ে হবে 5°C। সমুদ্রের জলতল বাড়লে ডুবে যাবে উপকূল ও দ্বীপরাষ্ট্র গুলি। আগামী 50 বছরের মধ্যেই 5763 কিমি ভূ-ভাগ ভারতের সমুদ্রের জলের তলায় তলিয়ে যাবে। 2030 সালে বাংলাদেশের 17% স্থলভূমি জলমগ্ন হবে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দ্বীপরাষ্ট্রগুলি ডুবে যাবে। 2030 সালে ভারতের প্রায় ৪% ভূমি জলমগ্ন হবে। 2050 সালে ভূমধ্যসাগরের 15% উপকূলবর্তী নিম্নভূমি জলমগ্ন হবে। এইভাবে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়লে আগামী দিনে ডুবে যাবে কলকাতা, মুম্বাই, বোস্টন, লন্ডন ও চেন্নাই এর মতো শহর।

4. পরিবেশগত বাস্তুচ্যুত (Environmental Refugee) :

 উপকূল ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি ডুবে গেলে প্রচুর মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। 2050 সালে ভারতের প্রায় 1 কোটি মানুষ পরিবেশগত বাস্তুচ্যুত (Environmental Refugee) হবে। 2030 সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রচুর মানুষকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। 2050 সালে মালদ্বীপ, সেসিল, নেদারল্যান্ড, মরিশাস ও সুন্দরবনের অনেক মানুষকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। আগামী 100-300 বছরে পরিবেশ গত বাস্তুচ্যুত হবে পৃথিবীতে প্রায় আনুমানিক 110-120 কোটি মানুষ। 2100 সালের দিকে মিশরের বাসযোগ্য ভূমির প্রায় 26% জলে নিমজ্জিত হতে পারে।

5. জলবায়ুর পরিবর্তন : 

পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লে পরিবর্তন ঘটবে পৃথিবীর জলবায়ুর। বায়ুপ্রবাহ ও চাপ বলয়গুলির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। ফলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, তাপপ্রবাহ ও শৈত প্রবাহ লক্ষ্য করা যাবে। বিভিন্ন প্রকার দুরারোগ্য রোগের প্রকোপ বাড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে 1980-2015 সালের 133-375 মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, কমবে কৃষি উৎপাদন, পরিবর্তিত হবে ঋতু বৈচিত্র্য। বর্ষাতে হবে না নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি, আবহাওয়ার খামখেয়ালীপনা লক্ষ্য করা যাবে। ভূবন উষ্ণায়নের ফলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে কম সময়ের শীত ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস। অমরনাথের শিবলিঙ্গ গলে গিয়েছে, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি আজ উধাও। জলবায়ুর পরিবর্তনে জৈব ও ভৌত পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়বে। মেঘের উচ্চতা বাড়বে, জ্যৈষ্ঠের উষ্ণতা আরও প্রকটতর হবে।

 

6. প্রজাতির বিলুপ্তি : 

পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ।এডিনবরার গবেষকদের মতে উষ্ণতা বৃদ্ধির দরুণ আফ্রিকার বহু প্রাণীর মধ্যে আসছে জৈবিক বিবর্তন, ঘটছে প্রজাতিগত পরিবর্তন, বিপন্ন মাছের বংশবিস্তার। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা 3°C বৃদ্ধি পেলে 44% স্তন্যপায়ী, 23% প্রজাপতি ও কয়েক শতাংশ পাখি বিলুপ্ত হবে। ডাইনোসোর এর মতো মেরু ভাল্লুক ও পেঙ্গুইন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। বরফের আস্তরণ পাতলা হওয়ার জন্য 2050 সালে মেরু ভাল্লুকের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মারা যেতে পারে। এই শতকের মাঝামারি আলাস্কার উত্তর উপকূলবর্তী অঞ্চলেও রাশিয়া থেকে মেরু ভাল্লুক চিরতরে বিদায় নেবে এবং আন্টার্কটিকা অঞ্চল থেকেও প্রায় 42% মেরু ভাল্লুক হারিয়ে যেতে পারে। সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রজনন কমে যাচ্ছে।

7. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি : 

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাড়ছে খরা, বন্যা, ঘূর্নিঝড় প্রভৃতি। উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোন (1999), 2005 মুম্বাইয়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং USA তে ক্যাটরিনা, রিটা ও উইলমা (2005) কিংবা 2004 সালে ব্রাজিলের হ্যারিক্যান ঝড়, বাংলাদেশের সিডার, বিজলি, সুন্দরবনের আইলা ঝড় (2009) ও ওমানের গোনু সবই ভূবন উষ্ণায়নের প্রভাব। 2003 সালে গ্রীষ্মে ইতালি থেকে ফিনল্যান্ড, স্পেন থেকে হাঙ্গেরী যে তাপ প্রবাহ চলেছিল তার জন্য দায়ী বিশ্ব উষ্ণায়ন।

৪. কৃষিতে প্রভাব : 

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব কৃষিতে পড়ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। PNAS বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন পৃথিবীতে প্রতি I°C তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ধান উৎপাদনের 10% এবং গম উৎপাদনের 5-10% কমবে। 2040 সালের মধ্যেই আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশের খাদ্য উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যাবে। কৃষিজ ফসলের চরিত্র বদল হবে। প্রতি 2°C তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদনে যে পরিমাপে কমবে তাতে ভারতের GDP 5% পর্যন্ত হ্রাস পাবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দীর্ঘ খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। ভারতের কৃষি উৎপাদন কমে যাবে 20%। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (GDP) 1882-83 সালে যেখানে কৃষির অংশ ছিল 36.41% 2006-07 সালে তা নেমে এসেছে মাত্র 18.5%। এই হ্রাসের অন্যতম কারণ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন। গ্রীষ্মপ্রধান ভারতবর্ষে কৃষি উৎপাদন 30% কমে যাবে।

9. জৈব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট : 

গত শতাব্দীর তুলনায় বর্তমান শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে 13°-32°F। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা 1990 থেকে 2100 সালের মধ্যে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ হবে 2 11.5°F। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বহু প্রাণী নিজের বাসভূমিতে সুস্থির থাকতে পারছে না ফলে হ্রাস পাচ্ছে জৈব  বৈচিত্র্য ও বিপন্ন হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সংকটের মুখে মেরু ভাল্লুক, পেঙ্গুইন ও নোনা জলে বসবাসকারী কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদ। আলাস্কা ও প্রশান্ত মহাসাগরে স্যালমন মাছ কমে যাচ্ছে। উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলে উষ্ণ অঞ্চলের সামুদ্রিক প্রাণীরা মেরু অঞ্চলের দিকে চলে যাচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বা বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) এর ফলে সুন্দরবনে হারিয়ে গিয়েছে হগ হরিণ, বুনো মহিষ, জাভানা গন্ডার, লেপার্ড, বনবেড়াল, বুনো শুয়োর, চিতল হরিণ প্রভৃতি প্রাণী। জীব বিজ্ঞানী Hunter এর মতে 1878 সালে এদের অস্তিত্ব সুন্দরবনে ছিল। উষ্ণতা একবিংশ শতাব্দীতে 4.6°C বৃদ্ধি পেলে বহু প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থলের পরিবর্তন ঘটবে। 80% সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে দেখা গিয়েছে শারীর বৃত্তীয় পরিবর্তন।

10. EI-Nino ও La-Nino প্রকোপ বৃদ্ধি : 

বিজ্ঞানীদের মতে পেরু ও চিলি উপকূলে সৃষ্টি হওয়া El-Nino ও La-Nina এর সৃষ্টির মূলে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming)। ইহা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন করতে সক্ষম। বর্তমানে পৃথিবীতে খরা, বন্যা, নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার পেছনে রয়েছে এলনিনো ও লানিনার হাত।


বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধের ব্যবস্থা (Controlling of Global Warming) :

বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধ করতে না পারলে নিশ্চিহ্ন হবে মানুষ তথা পৃথিবী। পরিবেশ শিক্ষা (Environment Education) এর উপর অধিক জোর দিতে হবে। পৃথিবী উষ্ণায়ন প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলি নিম্নে আলোচনা করা জ


1. মন্ট্রিল প্রোটোকল (1987) ও এজেন্ডা 21’ (1992) মেনে চলা : 

1987 সালে কানাডার মন্ট্রিলে গৃহীত নীতিগুলিকে মেনে চলতে হবে। যেমন CFC গ্যাস এর ব্যবহার কমানো ও গ্রীণ হাউস গ্যাসগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং  ওজোন অবক্ষয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা। 1992 সালের ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা সম্মেলনে গৃহীত 21 এজেন্ডা মেনে চলা ৷ সেখানে বলা হয়েছে 2020 সালের মধ্যে পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বর্তমানের তুলনায় 30% হ্রাস করা হবে। 2000 সালের মধ্যে পৃথিবীতে অরণ্য নিধন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

2. জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস : 

জীবাশ্ম জ্বালানী (কয়লা, পেট্রোলিয়াম) যথা সম্ভব কম ব্যবহার করে বাতাসে CO, র পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব। এনার্জি এফিসিয়েন্সি ও ক্লিন টেকনোলজির উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

3. অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি : 

সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার ভাটা শক্তি, ভূতাপ শক্তি, পারমানবিক শক্তি, জলবিদ্যুৎ প্রভৃতি অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে। ফলে GHG আর বায়ুমণ্ডলে মিশছে না ভূবন উষ্ণায়নের হার দ্রুত হ্রাস পাবে।

4. হাইড্রোজেন শক্তি ব্যবহার :

 আগামী দিনে জ্বালানী হিসাবে হাইড্রোজেনের নাম উঠে আসছে। উন্নত দেশগুলি হাঁইড্রোজেন চলে এমন গাড়ি প্রস্তুত শুরু করে দিয়েছে। 25% কার্বণ-ডাই-অক্সাইড মেশে বায়ুমণ্ডলে শুধুমাত্র যানবাহনের ধোঁয়া থেকে, হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হলে সেই বিপদ থাকবে না।

5. বনসৃজন :

 অরণ্যছেদন রোধ, বৃক্ষরোপণ এর উপর বিশেষ নজর দিতে হবে। গাছ CO, কে শোষণ করে O, উৎপাদন করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। একটি বৃক্ষ বৎসরে প্রায় 12kg কার্বন ও 4 জন মানুষের 0, সরবরাহ কতে পারে। ] একর জায়গার বনভূমি যে CO, শোষণ করে তা 10 একর তৃণভূমির সমতুল্য। পরিবেশের মধ্যে কৃষি বনসৃজন ও সামাজিক বনসৃজনের উপর নজর দিতে হবে এবং সবুজ বলয় (Green Belt) তৈরীর দিকে থেকে নজর দিতে হবে। একটি পরিণত বৃক্ষ তার আয়ুষ্কালে 1 টনের মতো CO, শোষণ করে সমপরিমাণ O, আমাদের দেয়।

6. শক্তি অপচয় রোধ : 

বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় কমাতে হবে। ভৌম জলকে কৃষিকার্য যাতে না ব্যবহার করা হয়  সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ প্রতি ঘণ্টা 1 1/2--2 পাউন্ড কার্বন বাতাসে মেশায়। বাড়িতে সাধারণ বাঘ না জ্বালিয়ে CFL বাল্ব জ্বালালে প্রতি বছরে প্রায় 150 পাউন্ড CO, কম উৎপন্ন হয়।

7.. CFC গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করা : 

ফ্রিজ, এসিমেশিন, স্প্রে ক্যান ও রং তৈরিতে যে CFC গ্যাস ব্যবহার করা হয় তা বন্ধ করতে হবে। তার বদলে HFC ও HCFC ব্যবহার করতে হবে। অফিসগুলিতে হিম যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। CFC উৎপাদন নিষিদ্ধ করার জন্য London Protocal (1990) সব দেশ যেন মেনে চলে।

8.. যানবাহনের ব্যবহার কমানো:-

 যানবাহনের ধোঁয়া থেকে তৈরি হয় নানান গ্রীণ হাউস গ্যাস ৷ যা ভুবন উষ্ণায়নে সাহায্য করে। ইউরো প্রযুক্তি ব্যবহারে মোটরযান থেকে দূষণ হ্রাস পাবে। তাছাড়াও যানবাহনের ইঞ্জিনের ক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। নো ড্রাইভিং ডে ও স্বল্প দূরত্বের মধ্যে সাইকেল ব্যবহার এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহন ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে।

9. উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ : 

শিল্প কারখানায় ও পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত পুরাতন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। উন্নত দেশগুলি যাতে অনুন্নত ও উন্নয়ণশীল দেশগুলিকে প্রযুক্তি সরবরাহ করে তার ব্যবস্থা করা। ক্লিন টেকনোলজি ও গ্রীন টেকনোলজি ব্যবহার করা।

global warming definition
global warming causes
global warming paragraph
global warming wikipedia
global warming pdf
global warming and greenhouse effect
global warming bengali meaning
global warming can be controlled by
global warming definition causes and effects
global warming effect on environment
global warming facts
global warming greenhouse effect







Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)