Human Geography: Relation of Human Geography with Other Social Sciences and Branches of Human Geography

 ■ সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মানবীয় ভূগোলের সম্পর্ক (Relation of Human Geography with Other Social Sciences)

মানবীয় ভূগোল সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মানবীয় জনসংখ্যা, মানুষ পরিবেশ সম্পর্ক, মানুষের কার্যকলাপ এবং মানব সমাজের দৈশিক অবস্থার অধ্যায়ন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই কারণে অনুমান করা হয় যে মানবীয় ভূগোল অন্ত বিষয়ক প্রকৃতির (Interdiscliplinar Nature) । ফলস্বরূপ সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য উপশাখার সাথে মানবীয় ভূগোলের যোগসূত্রতা রয়েছে। নিচে মানবীয় ভূগোলের বিভিন্ন শাখার সাথে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সম্পর্কের ধরণ নিম্নে আলোচনা করা হল—


1. ইতিহাস ও ভূগোল (Relation between History and Geography) :

ইতিহাস ও ভূগোল মানব চেতনার সার্বিক ধরণকে ভুলে ধরে। ইতিহাস সময়কে নিয়ে অধ্যয়ন করে, এবং ভূগোল স্থানকে নিয়ে অধ্যায়ন করে। দুটি বিষয় ভিন্ন হলেও সময় ও স্থান একে অপরের সাথে সরাসরি জড়িত। ইতিহাস বা History শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Historia থেকে। যার অর্থ মানুষের অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও কার্যাবলীর অধ্যয়ন। বৃহৎ একটি বিষয় হওয়া সত্বেও এটি কখনও মানবিক বিজ্ঞান এবং কখনও বা সামাজিক বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই ইতিহাসকে মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখেন। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, যেমন মহাদেশ, দেশ ও শহর ইতিহাস অধ্যয়নের ক্ষেত্র। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কেন ঘটেছিল তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণ জানার জন্য ইতিহাসবিদগণ ভূগোল অধ্যয়ন করে থাকেন। পরিবে ইতিহাস হল ইতিহাসের একটি নতুন ক্ষেত্র, যা 1980 এর দশকে বিকাশ লাভ করে। এতে পরিবেশের ইতিহাস এব পরিবেশের উপর মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করা হয়। সংস্কৃতির ইতিহাস হল সমাজে শিল্পকল ও মানুষের চিত্র ও দৃশ্য ধারণার অধ্যয়ন। 1980 ও 1990 এর দশকে এটি সামাজিক ইতিহাসের স্থলাভিষিক্ত হয়। ২৭ মূলত নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সমন্বিত রূপ যেখানে ভাষা, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাংস্কৃতির ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। এতে অতীতে মানুষের জ্ঞানচর্চা, প্রথা ও শিল্পের নথি ও বর্ণনা পরীক্ষা করা হয়। অতীতে মানুষ কীভাবে তাদের স্মৃতি ধরে রেখেছিল তা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোচনার প্রধান বিষয়। উপরিউক্ত আলোচন? মানবীয় ভূগোলের অন্যতম শাখা হিসেবে ঐতিহাসিক ভূগোল আলোচনা করে।


2. অর্থনীতি ও ভূগোল (Relation between Economics and Geography) : 

অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান-এর একটি শাখা। অর্থনীতি শব্দটি ইংরেজি Economics' শব্দের প্রতিশব্ Economics শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Oikonomia’ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ গৃহস্থালী পরিচালনা। অর্থনীতির জনক হিসেবে। পরিচিত অ্যাডাম স্মিথ। তিনি 1776 খ্রিস্টাব্দে 'An Enquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি বলেন, 'Economics is prince of wealth' অর্থাৎ অর্থনীতি হল সম্পদের বিজ্ঞান। অর্থনীতি মানব জীবনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্টের উপর প্রতিষ্ঠিত যথা, অসীম অভাব, সীমিত সম্পদ ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সম্পদ। সহজ কথায় বলতে, অর্থনীতি হল সমাজ বিজ্ঞানের সেই শাখা যা মানুষকে স্বল্প সম্পদের মাধ্যমে তার অসীম অভাব পূরণের পথ দেখায়। অধ্যাপক এল রবিনস বলেন “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদ এর মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করে। মানবীয় ভূগোলের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে অর্থনৈতিক ভূগোলের সাথে অর্থশাস্ত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভূগোল ও অর্থশাস্ত্রের মিথস্ক্রিয়ার ফল হল অর্থনৈতিক ভূগোল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ তার সঙ্গে সম্পর্কিত উৎপাদন বন্টন ও ব্যবহার সম্পর্কিত আলোচনা এই মিথস্ক্রিয়ারই ফল।


 3. সমাজতত্ত্ব ও ভূগোল (Relation between Sociology and Geography) :

সমাজবিজ্ঞান বা সমাজবিদ্যা বা সমাজতত্ত্ব মানুষের সমাজ বা দলের বৈজ্ঞানিক আলোচনা শাস্ত্র। এতে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের সামাজিক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমাজ বিষয়ক গবেষণা অতীত কাল থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে অগাস্ট কোৎ সর্বপ্রথম 1838 সালে এর রীতিবদ্ধ আলোচনা করেন। এছাড়া হার্বাট স্পেনসার সমাজবিজ্ঞানের মূলনীতিগুলি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের মূল স্থপতি হিসেবে ফরাসি পণ্ডিত এমিল ডুখাইম এবং জার্মান সমাজবিজ্ঞানী মাক্স ভেবারের নাম উল্লেখযোগ্য।

সমাজবিজ্ঞান স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ঊনবিংশ শতকে। অগাস্ত কোৎ কর্তৃক প্রথম ব্যবহৃত “Sociology' প্রত্যয়টি এসেছে ল্যাটিন 'Socious' ও গ্রীক 'Logos' নামক দু'টি শব্দ থেকে। যার শব্দ অর্থ দাঁড়ায় সমাঙ্গের বিজ্ঞান (Sciecne of Society)। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজবিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করেন বিভিন্ন দৃষ্টিভষ্ঠি থেকে। সমাজতত্ত্ব শুধুমাত্র মানুষের সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে না, তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানুষ যে সমাজের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে সে সমাজের প্রকৃতি, সামাজিক পদ্ধতি, রীতিনীতি, সংস্কৃতি আচার-ব্যবহার, ধর্ম, জাত, গোষ্ঠী প্রভৃতি নিয়ে সার্বিকভাবে আলোচনা করে।

মানবীয় ভূগোলের অন্যতম শাখা হিসেবে সামাজিক ভূগোলের এর সাথে সমাজতত্বের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশের মধ্যে দৈশিক ধরন ও কার্যকারী সম্পর্কের ফলে সমাজের যে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন তৈরি হয়েছে, তা সামাজিক ভূগোলে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়। শুধু তাই নয়, মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তন, সামাজিক পদ্ধতি, সামাজিক গোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের রসায়ন, এই সমস্ত বিষয় সমাজতত্ত্ব ও মানবীয় ভূগোলের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত।


4. নৃবিজ্ঞান ও ভূগোল (Relation between Anthropology and Geography) :

নৃবিজ্ঞান মানুষের (Homo Sapiens) অতীত ও বর্তমান সম্পর্কিত একটি অধ্যয়ন। মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির জটিলতা অনুধাবন ও বিভিন্ন সমাজের জীবনযাপন পাঠের প্রয়োজনে নৃবিজ্ঞান হলো সামাজিক, জৈবিক, ভৌত ও মানবিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকাণ্ড। নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকে বিভিন্ন মানবীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে বেড়ানোই নৃবিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য। 'নৃবিজ্ঞান' হল ইংরেজী 'এ্যাস্থোপলজি'-র (Anthropology) বাংলা প্রতিশব্দ। এ্যান্থোপলজি কথাটির মূল রয়েছে একটি গ্রীক শব্দ 'অ্যান্থোপস' (Anthropos), যার অর্থ মানুষ। সংস্কৃতি শব্দ নৃ' মানেও তাই। কাজেই 'নৃবিজ্ঞান' কথাটির অর্থ দাঁড়ায় 'মানক বিষয়ক বিজ্ঞান' (উল্লেখ্য, বাংলায় এ্যাছো পলজির প্রতিশব্দ হিসাবে মানব বিজ্ঞান কথাটি কেউ কেউ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা বহুল প্রচলিত নয়)। তবে নৃতত্বের অর্থ হলো মানুষের বা মানব জ্ঞাতির আলোচনা। নৃতত্ত্বের বিষয় হল আদিম মানুষের শারীর তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ব। অনুরূপভাবে মানবজাতিতত্ব (Ethnology) ও নৃবিদ্যা এর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বিষয়। আলোচনা বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে নৃবিদ্যা তিনটি ভাগে বিভক্ত। এগুলি হল—শারীরিক নৃবিদ্যা, সাংস্কৃতিক নৃবিদ্যা ও সামাজিক নৃবিদ্যা।

মানবীয় ভূগোল ও নৃবিদ্যা দুটি বিষয়ের মধ্যে পারস্পারিক দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এই যোগসুত্রতার ফলশ্রুতি হিসেবে সাংস্কৃতিক ভূগোল গড়ে উঠেছে। অনেকেই একে “Anthropogeography" ও বলে। সাংস্কৃতিক ভূগোল মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তন, সাংস্কৃতিক উৎস স্থল, সংস্কৃতির স্থানাস্তর, উদ্ভাবন, ব্যাপন, নরগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক পদ্ধতি, সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যেমন, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, উপজাতি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে।


5. রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগোল (Relation between Political Science and Geography):


রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের একটি শাণাবিশেষ; যেখানে রাষ্ট্র সরকার এবং রাজনীতি সম্পর্কীত বিষয়াবলী নিয়ে আলোকপাত করা হয়, সাধারণভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে সে বিষয়টিকে বুঝায়; যা সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনৈতিক বা রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করে। শব্দগত অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Political Science। এটি এসেছে গ্রিক শব্দ Polis থেকে। যার অর্থ হল 'নগর'। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে প্রতিটি নগরকে এক একটি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হতো। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট এর মতে; "“রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে। “অধ্যাপক গেটেল এর মতে; “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে। “অধ্যাপক বার্জেস এর মতে; “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার বিজ্ঞান। “পরিশেষে বলা যায় যে; রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন এক সামাজিক বিজ্ঞান যেখানে রাষ্ট্র; রাজনীতি ও রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবস্থার তুলনামূলক বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও পর্যালোচনা করে

মানবীয় ভূগোলের অন্যতম শাখা হিসেবে রাজনৈতিক ভূগোলের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। তার ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ভূগোল ও ভূ-রাজনীতি (Geopolitics) ধারণা গড়ে ওঠে।


6. জনবিজ্ঞান ও ভূগোল (Relation between Demography and Geography) : 

জনবিজ্ঞান সামাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যেখানে মানবীয় জনসংখ্যার বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যায়ন করা হয় অর্থাৎ মানবীয় জনসংখ্যা আয়তন, গঠন ও উন্নয়ন প্রভৃতি। প্রাথমিকভাবে জনবিজ্ঞান জনসংখ্যা পরিবর্তনের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, জনঘনত্ব, জন্মহার, মৃত্যুহার, স্থানাস্তর, জনসংখ্যার গঠন যেমন, বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, ভাষা জাতি প্রভৃতি। মানবীয় ভূগোলের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে জনসংখ্যা ভূগোলের সাথে জনবিজ্ঞান এর গভীর এবং সরাসরি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণ অর্থে বলা যায় জনবিজ্ঞান ও জনসংখ্যা ভূগোল একে অপরে পরিপূরক, দুটি বিষয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায় না। দুটি বিষয় একে অপরের উপর নির্ভরশীল।

মানবীয় ভূগোলের শাখা সমূহ (Branches of Human Geography) :

মানবীয় ভূগোল ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। সাধারণভাবে ভূগোলের যে শাখায় মানুষ বা মানবীয় গোষ্ঠীর বৈশিষ্টা, বিবর্তন স্থানাস্তর, বসতি, জীবিকা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি কার্যকলাপ সম্পর্কে রীতিবদ্ধ আলোচনা করা হয় তাকে মানবীয় ভূগোল বলা হয়। ফ্রান্সের মানবীয় ভূগোলবিদ ভিদেল দা লা ব্লাচেকে মানবীয় ভূগোলের জনক বল হয়। তাঁর মতে মানবীয় ভূগোল হল পৃথিবী আর তার অধিবাসীদের সমাজের বর্ণনা। হান্টিংটনের মতে মাটি, জল ও বায়ুর প্রভাবে উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের জীবনের যে পরিবর্তন আসে, তা এক স্থানের জীবনযাত্রা থেকে অন্য স্থানের জীবনযাত্রার পার্থক্য নির্দেশ করে, তারই ব্যাখ্যা আলোচনা মানবীয় ভূগোলের মূল আলোচ্য বিষয়। আলেকজান্ডার হামবোল্ট এর মতে কোন স্থান বা এলাকার বসবাসকারী মানবীয় গোষ্ঠী সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা ও বিবরণ করা। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানবীয় ভূগোল এর ধারণা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন শাখা গড়ে উঠেছে। এর মূঢ় কারণ হলো মানুষ সৃষ্টি বা মানব সৃষ্ট বিভিন্ন উপাদান মানবীয় ভূগোলের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে পৃথক করলেও, ই শাখা গুলি পরস্পর অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। মানবীয় ভূগোলের প্রধান শাখাগুলি হল


1. সামাজিক ভূগোল (Social Geography):

মানুষ একদিকে সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির ধারক ও বাহক, যে কারণে মানব গোষ্ঠী হল মানবীয় ভূগোলের ভিত্তি রচনার প্রধান উপাদান যা মানবীয় ভূগোলে একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে সামাজিক ভূগোলকে রচনা করেছে। এই সামাজিক ভূগোল নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, মানব গোষ্ঠীর উৎপত্তি ও বিকাশ, মান সভ্যতার ক্রমবিকাশ, রাষ্ট্রে উৎপত্তি ও বিকাশ, বসতির উৎপত্তি ও বিকাশ প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ক হয়। সামাজিক ভূগোলের কতগুলো উপাদান দেখা যায় যা মানবীয় ভূগোলের উপশাখা হিসেবে পরিচিত। সামাজিক ভূগোলের শাখা গুলি হল—


(i) নৃতাত্ত্বিক ভূগোল (Anthropo Geography) :

নৃতাত্ত্বিক ভূগোল সমাজ বা সামাজিক ভূগোলের একটি নতুন শাখা। এই ভূগোল মানব গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট, ঐতিহাসিক বন্টন ও মিশ্রণ, শারীরবৃত্তীয় নৃতত্ব, মানবদেহের আকৃতিগত পার্থক্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্টা ও মানসিক গঠন, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সমাজের প্রকৃতি, নারীদের স্থান ধর্ম প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়, যা সমাজ ভূগোলের বৃহত্তর ও আলোচনার অঙ্গ।

(ii) ঐতিহাসিক ভূগোল (Historical Geography) :

ঐতিহাসিক ভূগোল এর সূচনা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের ক্রিয়া-কলাপ, চিন্তাধারা, মানসিক উৎকর্ষতা প্রভৃতির অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে। ঐতিহাসিক ভূগেছ। হচ্ছে সেই ভূগোল যেখানে কোন দেশের গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করে অর্থাৎ সেই দেশের অর্থনৈহির কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক বিভিন্নতা, ধর্ম ও ভাষাগত বিভিন্নতা প্রভৃতির নিরিখে কিভাবে সেই রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছে তার ভৌগোলিক বিশ্লেষণ করে।

(iii) রাজনৈতিক ভূগোল (Political Geography) :

পৃথিবীর কোন একটি নির্দিষ্ট দেশের রাজনৈতিক বিষয়ের ভৌগোলিক পর্যালোচনামূলক শাস্ত্রকে রাজনৈতিক ভূগেরবলে। স্বাভাবিকভাবে কোন রাজনৈতিক এলাকা তথা রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব ও তাৎপর্য এর বিশ্লেষণ রাজনৈতিক ভূগোলের আলোচনার মূল বিষয়। তাছাড়া রাজনৈতিক ভূগোলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল রাষ্ট্রের সীমানা, সীমান্ত, কেন্দ্রভূমি, রাজধানী, বিভিন্ন রাজ্যে আন্তঃ সমস্যা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্ত সমস্যা, জাতিগত বিন্যাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক ঘটনা, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রভৃতি।

 (iv) বসতি ভূগোল (Settlement Geography) : 

বসতি ভূগোল হল মানবীয় ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যেখানে পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর গড়ে ওঠা মানব বসতির উৎপত্তি, বৃদ্ধি, অবস্থানিক, ধরণ, গঠন, কার্যকারিতা, দৈশিক অবস্থান প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বসতি ভূগোলকে দুটি উপশাখাতে ভাগ করা হয়।


2. অর্থনৈতিক ভূগোল (Economic Geography) :

অর্থনৈতিক ভূগোল প্রাকৃতিক ও মানবীয় পরিবেশের সাথে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অবনতির সম্পর্ক বুঝিয়ে দেয় এবং মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কথা বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন সম্পদের উৎপত্তিস্থল এবং বন্টনের প্রকৃত কারণ আলোচনা করে অর্থনৈতিক ভূগোল। অর্থনৈতিক ভূগোলের উপশাখা গুলি হল—

(i) সম্পদ ভূগাল (Resource Geography) :

সম্পদ ভূগোল অর্থনৈতিক ভূগোলের সেই উপশাখা, যেখানে সম্পদ ও তার বন্টন, উৎপাদন, ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। এক্ষেত্রে সম্পদ বলতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসম্পদ উভয়কেই বোঝায়।

(ii) কৃষি ভূগোল (Agricultural Geography) :

কৃষি ভূগোল হলো মানবিক ভূগোলের এমন একটি উপশাখা। কৃষি ভূগোল বিভিন্ন কৃষি পদ্ধতি ও কৃষিকাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীর কৃষির বন্টন ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়।

(iii) শিল্প ভূগোল (Industrial Geography) :

শিল্প ভূগোল হল মানবীয় ভূগোল তথা অর্থনৈতিক ভূগোলের এই উপশাখা, যেখানে শিল্পসংক্রান্ত কার্যাবলীর দৈশিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। শিল্প ভূগোল মূলত উৎপাদন অর্থাৎ মাধ্যমিক শিল্প এর অবস্থান ও বন্টন নিয়ে আলোচনা করে।

(iv) পরিবহন ভূগোল (Transport Geography) :

ভূগোলের যে শাখা পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে থাকে তাকে পরিবহন ভুগোল বলে।

3. জনসংখ্যা ভূগোল (Population Geography);

বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যার বন্টন ও ঘনত্ব, জনসংখার বৃদ্ধি, নারী পুরুষের অনুপাত, জন্ম মৃত্যু হার, পরিব্রাজন প্রভৃতি বিষয় জনসংখ্যা ভূগোল আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে থাকে।


4. সাংস্কৃতিক ভূগোল (Cultural Geography):

সংস্কৃতি হলো মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টি এবং সমাজের দর্শন স্বরূপ। এ স্বরূপ উদঘাটনের জন্য ভূগোলবিদগণ বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সাথে একাত্ম হয়ে তাদের জীবনধারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুধাবন করেন এবং ক্রমে এ অনুধাবনের ফলে মানবীয় ভূগোলে সাংস্কৃতিক ভূগোল নামে স্বতন্ত্র শাখার উদ্ভব ঘটেছে।


5. আঞ্চলিক ভূগোল (Regional Geography):

কোনো এলাকার বা আঞ্চলের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনামূলক ভূগোলকে আঞ্চলিক ভূগোল বলে। “অঞ্চল” প্রাসঙ্গিকতা ভূগোল শাস্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুতরাং প্রাকৃতিক ও মানবীয় উভয় ভিত্তিতে “অঞ্চল” এক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ কেননা মানবীয় বিষয়াবলির আঞ্চলিক তাৎপর্য উদঘাটন করার ফলে মানব সম্প্রদায় ও তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্যক ধারণ লাভ করার সাথে সাথে মানবীয় বৈশিষ্ট্যাবলির আঞ্চলিক ধ্যান-ধারণা সম্পর্কেও সবিশেষ অবহিত হওয়া যায়।


6. পরিবেশ ভূগোল (Environmental Geography) :

পরিবেশগত ভূগোল মানবীয় ভূগোলের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ভূগোলের যে শাখা পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করে তাই হচ্ছে পরিবেশ ভূগোল। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবসৃষ্ট পরিবেশের মধ্য দিয়ে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।


7. নগর পরিকল্পনা (Urban Planning):

শহর বা নগরের বর্তমান অবস্থাকে অদূর ভবিষ্যতে আরও কতোটা সুন্দর করে গড়ে তোলা যায় এর সঠিক পরিকল্পনাকেই নগর পরিকল্পনা বলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে ওঠা পৃথিবীর নগরগুলো দেখতে খুব সুন্দর এবং নগরবাসীরা ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকে।






Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)