Human Geography: Introduction to Human Geography(Chapter-1)

 ■ মানবীয় ভূগোলের সংজ্ঞা (Definition of Human Geography) :

"Human Geography is the Science which studies spatial distribution of human being and cultural facts on the surface of the Earth". অর্থাৎ “মানবীয় ভূগোল এমনই এক বিজ্ঞান, যা মানুষের স্থানিক বণ্টনের সাথে সাথে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।” মানবীয় ভূগোলের সংজ্ঞাগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল—


1.)  ই. সি. সেম্পল (Ellen Churchill Semple, January 8, 1863 - May 8, 1932) : 

                আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মানবীয় ভূগোলবিদ ই.সি. সেম্পল (1911) বলেন, পরিবর্তনশীল মানুষ ও অস্থিতিশীল পৃথিবীর আন্তঃসম্পর্কই আলোচনা করে মানবীয় ভূগোল।

2. ফ্রেডরিক র্যাটজেল (Friedrich Ratzel, August 30, 1844 August 9, 1904):- 

                    জার্মানির মানবীয় ভূগোলবিদ ফ্রেডরিক র্যাটজেল (1904) এর মতে, পৃথিবীয় ভূগোল, ভূপৃষ্ঠ ও মানব সমাজের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়গুলিকে আলোচনা করে।

3. ভিদেল দ্য ল্য ব্লাচে (Raul Vidal de La Blache, January 22, 1845 April 5, 1918) : 

ফ্রান্সের মানবীয় ভূগোলবিদ ভিদেল দ্য ল্য ব্লাচে (1926) এর মতে, পৃথিবী ও মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ককে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করে। প্রাকৃতিক নিয়মগুলি পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে তবে মানুষ প্রকৃতি নির্ভর নয় বরং তার প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্য মেধা ও বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকৃতিকে কাজে লাগাতে পারে।

4. অ্যালবার্ট দেমানজিওন (Albert Demangeon, 13 June, 1872 - 25 July, 1940) : 

                    ফ্রান্সের মানবীয় ভূগোলবিদ অ্যালবার্ট দেমানজিওন (1933) এর মতে, মানবীয় ভূগোল হল মানব গোষ্ঠীর ও সমাজের আলোচনা, যার সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্পর্কও রয়েছে।

5. ম্যাক্সিমিলন সরি (Maximilien Sorre, 16 July, 1880 - 10 August, 1962) : 

ফ্রান্সের মানবীয় ভূগোল ভূগোলবিদ ম্যাক্সিমিলান সরি (1952) যিনি মাক্স সরি নামে পরিচিত, তাঁর মতে, মানবীয় ভুগোল মানুষকে এই প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম জীব হিসেবে দেখে, যে পরিবেশের কার্যকলাপে সর্বাধিক সাড়া দেয়।

6. জ্যাকি স্মিথ (Jackie Smith) :

জ্যাকি স্মিথ তাঁর গ্রন্থ ‘Dictionary of Geography’ তে বলেছেন যে মানবীয় ভূগোল হল, মানুষের বা কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট বা কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত ভূপৃষ্টের ঘটনা বা বিষয় সমূহের ভৌগোলিক আলোচনাই হল মানবীয় ভূগোল ৷

7. আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট (Friedrich Wilhelm Heinrich Alexander Von Humboldt, 14 September, 1769 6 May, 1859) :


জার্মানির ভূগোলবিদ আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট এর মতে, কোন স্থান বা এলাকায় বসবাসকারী মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও বিবরণ প্রদান করা মানবীয় ভূগোলের কাজ।

মানবীয় ভূগোলের উপাদান সমূহ (Components of Human Geography) :

পৃথিবী বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্য কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশে নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব মানুষ বাস করেন তাঁদের চেহারা, আচার আচরণ ও পোশাক পরিচ্ছদ যেমন বিভিন্ন, তেমনি ভাষা-ধর্ম শিক্ষা-চিন্তাধারাও এক নয়। এক এক জায়গায় বাসগৃহ নির্মাণ প্রণালী, খাদ্যগ্রহণ প্রণালী, জীবনযাপন প্রণালী এক এক রকম। সেই অনুযায়ী এক এক জায়গায় এক এক রকম শাসনতন্ত্র ও আইনকানুন গড়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসব উপাদান ও উপকরণ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে মানবীয় ভূগোলে বলা হয় পরিবেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের জীবন ধারণ প্রণালীর মধ্যে যে পার্থক্য আমরা দেখি, তা প্রধানত নির্ভর করে পরিবেশের পার্থক্যের উপর।

           মানবীয় ভূগোল দুটি পরিবেশের উপাদান নিয়ে গঠিত। এগুলি হল—
 A. প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান

B. সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপাদান

এই সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলঃ


A. প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান (Components of Physical Environment) :

               যে কোন অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ পাঁচটি উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে। এগুলি হল ---


(ক) গোলকরূপে পৃথিবী (The Earth as a Globe) : গোলকরূপে পৃথিবী তার অক্ষের (Axis) ওপর - কোণে হেলে সূর্যের চারদিকে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে এবং এর ফলে দিন রাত্রি হচ্ছে। 66 পৃথিবীর অক্ষ 66° কোণে হেলে থাকার জন্য দিন রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। এভাবে আবর্তন করতে করতে 365 দিনে পৃথিবী সূর্যকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করে। এর ফলে ঋতু-পরিবর্তন হয়।


পৃথিবী গোলাকার বলে কোথাও সূর্যরশ্মি লম্বভাবে, কোথাও বা তির্যকভাবে কিরণ দেয়। এর ফলে অক্ষাংশ (Latitude) অনুযায়ী পৃথিবীতে উষ্ণ ও শীতলস্থান গড়ে ওঠে। নিম্ন অক্ষাংশে অবস্থিত নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয় ফলে উষ্ণতা খুব বেশি। উচ্চ অক্ষাংশে মেরু প্রদেশে সূর্য তির্যকভাবে কিরণ দেয় বলে এখানে শীত খুব বেশি। এই উষ্ণতার পার্থক্যের জন্যই দুই জায়গার মানুষের জীবনযাপন প্রণালী দু'রকম। সুতরাং পৃথিবীর গোলক আকার মানবীয় ভূগোলের প্রধান উপাদান।


(খ) ভূ-প্রকৃতি বা ভূমিরূপ (Landforms) : 

                   ভূ-পৃষ্ঠে পর্বত, মালভূমি ও সমভূমি – এই তিনটি প্রধান ভূমিরূপ - দেখা যায়। ভূমিরূপ মানুষের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে, এর ফলে অর্থনৈতিক জীবনের তারতম্য হয় –


● পার্বত্যভূমির কঠিন শিলাগঠিত বন্ধুর ভূ-প্রকৃতি একদিকে কৃষিকার্য ও শিল্পকার্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। আবার অপরদিকে তেমনি পার্বত্য পরিবেশে মূল্যবান বৃক্ষাদি জন্মায়। তাই মূল্যবান কাষ্ঠ সম্পদের সরবরাহ সত্ত্বেও প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের দরুন পার্বত্য অঞ্চল জনবিরল এবং অনুন্নত। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসের দরুন পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা সাহসী, পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু এবং অধ্যাবসায়ী হয়ে থাকে।


• ভূ-পৃষ্ঠের মালভূমিগুলো সাধারণভাবে কৃষিকার্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে অনুপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু কোন কোন মালভূমি অঞ্চল খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যহেতু শিল্পোন্নত হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেরে ছোটনাগপুর মালভূমি ও কর্ণাটকের মালভূমির কথা বলা যায়। এই দুটি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার খনিজ দ্রব্য উত্তোলিত হয়। তাই এই দুটি মালভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা পৃথিবীর অন্যান্য মালভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক অবস্থার থেকে উন্নততর।


(গ) মৃত্তিকা (Soil) :

      মানুষের কাছে মৃত্তিকার ভূমিকা বিশাল। নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে মৃত্তিকা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে


(i) কৃষি জমির প্রকৃতিঃ মানুষের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কৃষিকাজ। এই কৃষিকাজের সাফল্য নির্ভর করে মাটির গুণাগুণের উপর। উর্বর মাটি যেমন চাষের পক্ষে আদর্শ, তেমনি অনুর্বর মাটি চাষের পক্ষে অনুপযুক্ত। উদাহরণঃ দাক্ষিণাত্যের কালোমাটি বা সারনোজেম মাটি তুলো চাষের পক্ষে আদর্শ মাটি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় নদী উপত্যকাগুলির উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূলে আছে সেখানকার পলিগঠিত উর্বর মাটি।


(ii) ফসলের প্রকৃতি : সব ধরনের ফসল একই রকম মাটিতে উৎপন্ন হয় না। বিভিন্ন ফসলের চাষের জন্য বিভিন্নরকম মাটি উপযুক্ত। উদাহরণ : কালোমাটিতে যেমন তুলোর চাষ ভাল হয়, তেমনি পলি মাটিতে ধান এবং লোহা-সমৃদ্ধ মাটিতে চা চাষ ভাল হয়।


(ঘ) খনিজ সম্পদ (Mineral Resources):- 

 সম্পদের আবিষ্কারও মানুষের জীবনযাত্রার উপরে প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর খনিজ সম্পদের অবস্থান সরাসরি মানবীয় জীবনযাত্রার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে

(1) শিল্পোয়তি:  বিভিন্ন খনিজ সম্পদের উপর নির্ভর করে লোহা ইস্পাত, খনিজ তেল শোধনাগার, অ্যালুমিনিয়াম প্রকৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলির উন্নতি ও বিকাশ।

(ii) বিদ্যুৎ উৎপাদন : বিদ্যুৎ শক্তি আধুনিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি জ্বালানী ও তেজ্ঞপ্রিয় নিজ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয়।


(iiii) জনবসতি বিস্তার অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিকূল হলেও, শুধুমাত্র খনিজ সম্পদ অধ্যুষিত দুর্গম স্থানেও জনবসতি গড়ে ওঠে। উদাহরণ(ক) অস্ট্রেলিয়ার ধু-ধু মরু প্রান্তরে সোনার খনি আবিষ্কারের পর সেখানে শিল্প ও শহর গড়ে উঠেছে। (খ) দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার সৌদি আরব ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতেও মরুভূমির মাঝে তেলখনি আবিষ্কারের পর, ওই সব তেলখনিকে কেন্দ্র করে সুন্দর সুন্দর আধুনিক শহর গড়ে উঠেছে। (গ) 'সাকুচি’ এক সময় ছিল বিহারের একটি অখ্যাত গ্রাম। ওই অঞ্চলে আকরিক লোহা আবিষ্কারের পর, স্যার জামশেদজি টাটা সেখানে একটি লোহা-ইস্পাত কারখানা (টাটানগর) গড়ে তোলেন (1907)। বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের 'সাকুচি', ভারতের অন্যতম জনবহুল শিল্পনগরী জামসেদপুর।


(ঙ) জলবায়ু (Climate) :

 প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যান্য উপাদানগুলির তুলনায় মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ু সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। জলবায়ু শুধু মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলীকেই প্রভাবিত করে না, তার কর্মশক্তি, মানবিক বিকাশ, স্বাস্থ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান, খাদ্য প্রভৃতিও বহুলাংশে জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু কীভাবে মানুষের অর্থনৈতিক কাকলাপ ও জীবনধারাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে তা নিচে আলোচনা করা হল।

(i) কৃষিকাজ জলবায়ুর প্রধান দুটি উপাদান উচ্চতা ও বৃষ্টিপাত। এ দুটির অভাবে কৃষিকাজ করা একেবারেই সম্ভব। হয় না। উদাহরণঃ প্রয়োজনীয় উষ্ণতা নেই বলে তুন্দ্রা ও মেরু অঞ্চলে কৃষিকাজ যেমন করা যায় না, তেমনি বৃষ্টিপাতের অভাবে শুষ্ক ঊষর মরুপ্রান্তরেও কৃষিকাজ করা প্রায় অসম্ভব। যদিও বর্তমানে কোন কোনও শুষ্ক অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে জলসেচ করা হচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। শুধু কৃষিকাজকেই নয়, জলবায়ু কুষিজ্ঞ ফসলকেও নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ: ঊষ্ণ ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু ধান চাষের উপযুক্ত হওয়ায়, ভারতে প্রচুর পরিমাণে ধানের চাষ হয়। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকার শীতল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে ধান চাষ সম্ভব হয় না। আবার ঊষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের পার্থক্যের জন্যই পাঞ্জারে গমের চাষ হয়, কেরালায় রবারের চাষ হয়। সুতরাং একথা বলা যায়। যে, কোথায় কী ধরনের ফসল উৎপাদিত হবে তা প্রধানত নির্ভর করে জলবায়ুর পার্থক্যের উপর। জলবায়ু মানুষের খাদ্যের অভ্যাসকেও নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ পাঞ্জাবে প্রচুর গম উৎপন্ন হয় বলে সেখানকার অধিবাসীদের প্রধান খাদা রুটি। আবার, পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় বলে এখানকার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভাত।

(ii) স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও পশুপালন জলবায়ুর উপরই নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে স্বাভাবিক উদ্ভিদের পার্থক্য গড়ে উঠে। উদাহরণঃ বেশি উত্থপ ও বৃষ্টিপাতের জন্য নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে ঘন চিরহরিৎ (চিরসবুজ) বনভূমির সৃষ্টি হয়েছে। আবার শীতল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে দেখা যায় সরলবর্গীয় গাছের বনভূমি। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বনভূমির উপর নির্ভর করে, বিভিন্ন ধরনের কাঠের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এছাড়, পশুপালনে উন্নতিও জলবায়ুর উপর


B. সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপাদান (Compoments of Cultural Environment):


মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের উপর প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো, অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল থাকা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক উন্নতি যথেষ্ট কম হয়েছে। আবার এমন কিছু দেশ আছে, যারা প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশেও লক্ষণীয় উন্নতি করেছে। তা হলে বোঝা যাচ্ছে যে, অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের শেষ কথা নয়, এ ক্ষেত্রে অ-প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোনও অঞ্চলের বা দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে ধারণা করতে হলে, সেখানকার অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন প্রকৃতির সৃষ্টি, তেমনি অপ্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের সৃষ্টি।

মানুষের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে এমন কতকগুলি দৃশ্য বা অদৃশ্য উপাদান থাকে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ-ই সৃষ্টি করেছে। মানুষের সৃষ্ট এই পরিবেশকেই অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। অ-প্রাকৃতিক পরিবেশকে অনেকে সাংস্কৃতিক পরিবেশ (Cultural Environment)-ও বলে।

সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলি কিভাবে মানবজীবনকে প্রভাবিত করে, তা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

(a) জনবসতির ঘনত্ব (Population Density) : 
দেখা গেছে, জনসংখ্যা যেখানে বেশি, সেখানে মানুষের মধ্যে একটা সুষ্ঠু সমন্বয়ের পরিবেশ গড়ে ওঠে। মানুষে-মানুষে সেখানে ভাবের আদান-প্রদান হয় সহজে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ নিজেদের ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের মধ্যে আত্মিক মিলনের পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষেরই প্রয়োজনে জনবহুল অঞ্চলগুলিতে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, মন্দির-মসজিদ-গির্জা প্রভৃতি গড়ে ওঠে। এসব জায়গায় যেতে হয় সব ধরনের মানুষকেই বিভেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। জনবহুল প্রতিটি দেশেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষ এসব নির্বাচনে উৎসাহের সঙ্গে অংশ নেয়। ফলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সরকার গঠনে এবং দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। যেসব স্থান জনবসতি সেখানে মানুষে-মানুষে এই ধরনের আত্মিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। ইউরোপ বা ভারতের রাজনীতি, দেশের সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয়ে যতটা আগ্রহী, সাহারা মরুভূমিতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ততটা সচেতনতা ও উৎসাহ স্বাভাবিক কারণেই থাকতে পারে না।

(b) সাফল্য বা উন্নতির পরিমাণ (Amount of Success or Development) ঃ অনুকূল পরিবেশে মানুষের সাফল্য বা উন্নতিক পরিমাণ অধিক দেখা যায়। গাঙ্গেয় সমভূমি অথবা নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল অনুকূল পরিবেশে জন্য যেরূপ উন্নতি করেছে, তুন্দ্রা অঞ্চলের অনুর্বর মৃত্তিকা ও প্রতিকূল জলবায়ু ঐ অঞ্চলের উন্নতিতে তেমনি বাধা সৃষ্টি করেছে।

(c) স্বাতন্ত্রীকরণের পরিমাণ (Degree of Isolation) : স্বাতন্ত্রীকরণের পরিমাণের ওপর কোনও দেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, তুন্দ্রা অঞ্চল অথবা প্রশান্ত মহাসাগর বা অন্যান্য সাগরে অবস্থিত বহু দ্বীপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ঐ সব অঞ্চলে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখনও কিছু কিছু বজায় রয়েছে। কিন্তু যে সব দেশ উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সঙ্গে যুক্ত, সেই সব দেশে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের (Cultural Contact) ফলে সেই বৈশিষ্ট্য কিছু কিছু লোপ পেয়ে গিয়েছে।

(d) পেশা, সম্পদ ও মানুষের উৎসাহের স্থানীয় পার্থক্য (Local Difference between Occupation, Re source & Man's Inspiration) : কোনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে স্থানীয়ভাবে সম্পদগত, পেশাগত ও উৎসাহগত পার্থক্যের ফলে সাংস্কৃতিক পার্থক্য দেখা যায়। যেমন – নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে কৃষিজীবী অধিবাসীদের সংস্কৃতির মধ্যে কৃষি প্রভাব যেরূপ দেখা যায়, তেমনি উত্তর-পূর্ব হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে তাদের পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন প্রণালীর ছাপ (যেমন – পশুশিকার ইত্যাদি) ফুটে ওঠে। জাপানের ন্যায় বৃষ্টিবহুল, ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ, যেখানে প্রচুর কাঠ, রেশম ও তামা রয়েছে এবং যেখানে গৃহনির্মাণের পাথরের অভাব দেখা যায়, সেই সাথে শুষ্ক, বৃষ্টিহীন দেশ গ্রিস, যেখানে রেশম ও তামার অপ্রতুলতা এবং গৃহ নির্মাণের উপযুক্ত পাথরের প্রাচুর্য রয়েছে, তার সংস্কৃতিগত পার্থক্য যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। জাপানে অধিকাংশ গৃহ কাঠ দ্বারা নির্মিত এবং গৃহের ভিতরে রেশমের কাপড়ের উপর সুন্দর চিত্রাঙ্কন করে ও ব্রোঞ্জনির্মিত আসবাবপত্র দ্বারা সাজানো হয়। কিন্তু গ্রিসে গৃহাদি পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয় এবং গৃহের ভিতরে সুদৃশ্য মার্বেলের মূর্তির দ্বারা সাজান হয়ে থাকে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাংস্কৃতিক পরিবেশ কীভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত করে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)