মানবজীবনে জলবায়ুর প্রভাব (Impacts of Climate on Human Life)

 মানবজীবনে জলবায়ুর প্রভাব

প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে যে সব উপাদান লক্ষ করা যায়, তার মধ্যে সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ এবং শক্তিশালী উপাদান হল জলবায়ু; যা মানুষের জীবনযাত্রায় বা মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলিতে সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে (Papadakis, 1975)। স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও কৃষিকার্যের ওপর জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম; যা পরোক্ষভাবে মানুষের কার্যাবলির ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মানুষের জীবনধারণে জলবায়ুর দুটি উপাদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ; এর একটি হল আর্দ্রতা এবং অন্যটি তাপমাত্রা। তাই মানুষের কর্মজীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপেই জলবায়ুর স্পর্শ পাওয়া যায় (Cole, 1975 )।


1. স্বাভাবিক উদ্ভিদের ওপর জলবায়ুর প্রভাব (Effects of Climate on Natural Vegetation) :

 অক্ষাংশ ও উচ্চতা অনুসারে উয়তা ও বৃষ্টিপাতের ব্যাপক পার্থক্য ঘটে, যা স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকৃতি ও বণ্টনে প্রভাব বিস্তার করে। জলবায়ুর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উয়তা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকের উপস্থিতি উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি ও প্রজাতির বণ্টনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে ।


উদাহরণ : (i) অধিক উয়তা ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের জন্যই নিরক্ষীয় অঞ্চলে ঘন সেলভা অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে। (ii) নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলে সরলবর্গীয় অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে। (iii) শুষ্ক মরু অঞ্চলে অধিক পরিমাণে উয়তা এবং অতি অল্প বৃষ্টিপাতের জন্য তৃণ ও কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়ের সৃষ্টি হয়েছে।



2. তৃণভূমির ওপর প্রভাব (Effects on Grassland):

 পৃথিবীব্যাপী বৃষ্টিপাতের বণ্টন যথেষ্ট অসম। কম বৃষ্টি - এবং যে সকল স্থানে তিরঝিরে ধরনের বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে তৃণভূমি গড়ে ওঠে। বৃষ্টিপাতের আশালিক বণ্টনের ভারতবর ভিত্তিতে ভূণের উচ্চতা এবং প্রজাতিরও পার্থক্য ঘটে থাকে। তৃণভূমি পশুপালনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আদর্শ; তাই ডেয়ারিং দোহ শিল্পের উন্নতিতেও জলবায়ুর বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। 

উদাহরণ : (i) বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার জন্যই ভেগ, ভেল্ড, সাভানা, প্রেইরি ইত্যাদি তৃণভূমির সৃষ্টি হয়েছে। (ii) আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলে যে তৃণভূমি গড়ে উঠেছে তার দৈর্ঘ্য বা উচ্চতা অনেক বেশি। সেই উচ্চ তৃণভূমিতে হাতিও লুকিয়ে থাকছে। পারে বলে এই তৃণকে এলিফ্যান্ট তৃণ বলা হয়। 



3. কৃষিকার্যের উপর প্রভাব (Effects on Agriculture) ঃ 

মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ হল কৃষিকার্য। উন্নতা ও বৃষ্টিপাত-জলবায়ুর এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কৃষিকার্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুর তারতম্যের জন্য কৃষিজাত শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের খাদ্যাভ্যাস সেই অঞ্চলের জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। 

উদাহরণ : (i) ক্রান্তীয় অঞ্চলে রবার চাষ এবং মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে প্রচুর পরিমানে পাট ও ধানের উৎপাদন হয়। (ii) মধ্য অক্ষাংশের নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলে অনুকূল উয়তা ও বৃষ্টিপাতের সাহায্য নিয়ে পর্যন্ত পরিমাণে গমের চাষ হয়।



4. শিল্পের ওপর প্রভাব (Effects on Industry) : 

জলবায়ু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয়ভাবেই শিল্পস্থাপনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে শিল্প স্থাপনের প্রায় প্রত্যেকটি উপাদানই জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল, যেমন--

 (i) কাঁচামাল (Raw Materials) : শিল্প স্থাপনের জন্য খনিজ কাঁচামালের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিভিত্তিক কাঁচামালও প্রয়োজন। বৃষ্টিবহুল উয়ু-আর্দ্র জলবায়ুতে ধৌত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান আকরিক বক্সাইট উৎপন্ন হয়। জলবায়ুর তারতমে ভারত তথা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কৃষিজ কাঁচামালের পার্থক্য ঘটে বলে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছে। 

উদাহরণ : নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে পাট চাষের ব্যাপকতার জন্য হুগলি শিল্পাঞ্চলে পাট শিল্পের বিকাশ এবং মুম্বই ও আমেদাবাদে আর্দ্র জলবায়ুর সুবিধা নিয়ে বস্তুবয়ন শিল্পের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। আর্দ্র জলবায়ুতে যেমন সুতো বয়নে সুবিধা হয়। তেমনি শুষ্ক জলবায়ুতে ময়দা শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। নাতিশীতোয় জলবায়ু মৎস্য শিল্পে এবং ভূমধ্যসাগরীয় জলছে চলচ্চিত্র ও পর্যটন শিল্পে খ্যাতিলাভ করেছে।


(ii) শ্রমিক (Labour) : জলবায়ু শ্রমিকের কর্মদক্ষতাকেও প্রভাবিত করে। উহ্ণ জলবায়ুতে প্রচণ্ড গরমের জন্য শ্রমিক সহজের ক্লান্ত হয়ে পড়ায় কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। কিন্তু নাতিশীতোর জলবায়ুতে শ্রমিকেরা দীর্ঘসময় কাজ করেও ক্লান্তি বোধ করে না। 

উদাহরণঃ উষ্ণপ্রধান ভারতে শিল্প কারখানায় যুক্ত শ্রমিকদের থেকে ইউরোপের দেশসমূহে নিযুক্ত কারখানার শ্রমিকেরা অনেক বেশি দক্ষতা ও নিপুণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।


(iii) শিল্পের আয়তন (Size of Industry):  শিল্পের বিস্তার অনেকাংশে জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। অত্যাধিক উন্নতা বা অতি শীতলতা—জলবায়ুর এই দুই চরম অবস্থা শিল্পের এলাকাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। উদাহরণ : মেরু বা পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক শীতলতার জন্য অধিবাসীরা ঘরের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প গড়ে তোলে। ভারতের কাশ্মীরে পশম ও গালিচা শিল্প এভাবেই গড়ে উঠেছে।


(iv) বিদ্যুৎশক্তি (Power): শিল্প স্থাপনে শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন জলবায়ুর ওপর বিশেষভাবে অত্যধিক ঠাণ্ডাতে নদীর জল বরফে পরিণত হলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। আবার বৃষ্টির জল কম থাকলে নির্ভরশীল। যেমন জলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তেমনি অতিরিক্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বাধা দেয়। উদ্বু মরু অঞ্চলের অত্যধিক উন্নতা সৌরশক্তি উৎপাদনে এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে বায়ুশক্তির ব্যবহার সহজেই করা যায়। উদাহরণ: সেন্ট লরেন্স নদীতে শীতকালে বরফ জমে থাকায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে নিকটবর্তী শিল্পাঞ্চলে। জাপানে কয়লা পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলেও অনুকূল জলবায়ুর সাহায্যে ব্যাপক মাত্রায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ায় শিল্পাঞ্চলে শক্তি সরবরাহে কোনোরকম অসুবিধা হয় না।



5. বসতি ও বাসগৃহ (Settlement & House pattern):  

জলবায়ুর চরমভাব বসতি নির্মাণে বাধা দেয়। তাই অত্যাধিক উষ্ণতা বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত—এই দুটি উপাদানই যখন যে অঞ্চলে চরমভাবে অবস্থান করে সেখানে জনবসতির ঘনত্ব বেশি হয় না। 

উদাহরণ : মেরু ও উয় মরু অঞ্চলে প্রতিকূল জলবায়ুর অবস্থানের জন্য জনবসতির ঘনত্ব খুবই কম। এই দুই অঞ্চলে প্রতি বর্গকিমিতে 1 জনেরও কম লোক বাস করে। আবার মৌসুমি কিংবা ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে প্রতি বর্গকিমিতে 200 জনেরও বেশি লোক বসবাস করে। বাসগৃহের প্রকৃতিও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। যেসব স্থানে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে ঢালু ছাদযুক্ত বাড়ি নির্মিত হয়। আবার যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম, সেখানে সমতল ছাদবিশিষ্ট গৃহ গড়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের জন্য বাসগৃহের বৈচিত্র্য সহজেই লক্ষণীয় হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় বৃষ্টিপাত হয় বলে বাসগৃহগুলির ছাউনি ঢালু হয়। রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ইত্যাদি রাজ্যে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার জন্য সমতল ছাদযুক্ত ঘরবাড়ি গড়ে ওঠে। তবে রাজস্থানে গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শঙ্কু আকৃতির এক ধরনের গৃহ নির্মিত হয়; যা 'ঝোনপা' নামে পরিচিত। তুন্দ্রা অঞ্চলে এস্কিমোরা অত্যধিক শীতলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বরফ নির্মিত 'ইগলু' গৃহ তৈরি করে।



(6) জীবনের বিবর্তনের ওপর প্রভাব (Effects on the Evaluation of Life) : 

পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর জীবনের অগ্রগতি ও বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নিয়ামক হিসাবে জলবায়ুর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ম্যাথিউ (Mathew, 1915) | আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা পত্রিকায় (Ann, New fork, Aand, Sct. xxiv, 1915, P-212) একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। যার মধ্যে তিনি প্রকাশ করেন যে, এশিয়ার মধ্যভাগ বা কেন্দ্রীয় অংশ থেকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পদ্ধতিতে জীবনের বিস্তার ঘটে। তিনি দাবী করেন, মানুষ প্রাথমিকভাবে যেখানে বা যে জলবায়ুগত পরিবেশের মধ্যে অভিযোজন করে তা আধব ক্রান্তীয় জলবায়ু নয়, নাতিশীতোয় বা কম-বেশি শুষ্ক এলাকা। অতিশীতল এবং শুষ্ক এলাকা থেকেই মানুষের বিবর্তন শুরু হয়। মানুষের বিবর্তনের সত্যিকারের বাধা হয়ে দাঁড়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন বা ভৌগোলিক পরিবেশের পরিবর্তন। তবে বর্তমানে মনে করা হয় যে, নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত আফ্রিকা থেকেই নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মানুষের বিবর্তন ঘটে চলেছে।







Comments

Popular posts from this blog

হড়পা বান (Flash Flood): হড়পা বান কাকে বলে, ইহার বৈশিষ্ট্য ও কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে

মৌসুমি বিস্ফোরণ কাকে বলে ? মৌসুমি বিস্ফোরণের উৎপত্তির কারণ গুলি আলোচনা কর

চলক ও ধ্রুবকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Variable and Constant)