রসবি তরঙ্গ (Rossby Waves):রসবি তরঙ্গের সংজ্ঞা,উৎপত্তি,বৈশিষ্ট্য ও রসবি তরঙ্গের পরিবর্তন বিন্যাস
রসবি তরঙ্গ (Rossby Waves)
1930-এর দশকের শেষদিকে (1937-38 খ্রিস্টাব্দে) সি.জি. রসবি (C. G. Rossby) নামে এক আবহাওয়া বিজ্ঞানী উর্ধ্ব ট্রপোলি পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত এক ধরনের জিওস্ট্রফিক বায়ুর উপস্থিতি প্রমাণ করেন। তিনি তরঙ্গায়িত বা সর্পিলভাবে প্রতি এই ধরনের বায়ুর উপস্থিতিকে গাণিতিক পদ্ধতিতে প্রমাণ করেছিলেন বলে, তাঁর নামানুসারে এই তরঙ্গায়িত বায়ুপ্রবাহকে রসবি তরঙ্গ বলা হয় (MeIntosh & Thom, 1983 )।
★★রসবি তরঙ্গের সংজ্ঞা (Definition of Rossby Waves)
মধ্য ও উচ্চ টপোস্ফিয়ারে যে বৃহদাকার আঁকাবাঁকা বা সর্পিলাকার বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়, তাকে রসবি তরঙ্গ বলা যায় । রসবি তরঙ্গ অতি বক্র এবং বৃহৎ তরঙ্গ রূপে অবস্থান করে বলে এই তরঙ্গ কে ভূমণ্ডলীও তরঙ্গ (planetory wave) বলা হয় ।
★★ রসবি তরঙ্গের উৎপত্তি (Origin of Rossby Waves)
নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুর তুলনায় মেরু প্রদেশের বায়ু অনেক বেশি এবং প্রকৃতির। ঠিক এই কারণেই নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুর সমচাপ পৃষ্ঠ (Isobaric surface) অপেক্ষা মেরু অঞ্চলের বায়ুর সমচাপ পৃষ্ঠ অনেকটা নিম্নে অবস্থান করে। তাই নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে একটা ঢাল রচিত হয়। এই ঢাল বরাবর নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে বায়ু মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় (Treal artia, 1968) ।
নিরক্ষীয় অঞ্চলে কোরিওসি বলের প্রভাব শূ না। কিন্তু নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে যতই মেরু অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় ততই কোরিওলিস বলের প্রভাব বাড়তে থাকে। তাই বায়ু যখন নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরুর দিকে প্রবাহিত হয়, তখন কোরিওলিস বলের প্রভাবে বায়ু উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বিক্ষিপ্ত হয়। যখন বায়ুচাপের ঢালজনিত বল এবং কোরিওলিস বল সমান হয়ে যায়, তখনই একটি ভারসাম্য অবস্থা রচিত হয়। এই ভারসাম্যের জন্যই প্রবাহিত ওই বায়ু জিওস্ট্রফিক বায়ুতে পরিণত হয়, যা পশ্চিম থেকে পূর্বেপ্রবাহিত হয় (Stringer, 2003)।
ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুর চাপ ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তাই সমচাপ পৃষ্ঠের (Isobaric surface) ঢালও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঢাল দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রান্তীয় পশ্চিমা বায়ুর গতিবেগও বেড়ে যায়।
আবার উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জিওস্ট্রফিক বায়ুর কৌণিক ভরবেগও (Angular Momentum) বৃদ্ধি পায়। ট্রপোস্ফিয়ারের মধ্যে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমচাপ পৃষ্ঠের বায়ুপ্রবাহ ঢাল অত্যন্ত খাড়াই হতে থাকে। ফলে পশ্চিমা বায়ুর গতিবেগও বৃদ্ধি পায়। উচ্চতার সঙ্গে পরিবর্তনশীল এইরকম জিওস্ট্রফিক বায়ুকে তাপীয় বায়ুপ্রবাহ (Thermal wind) বলা হয় (Siddhartha, 2002)।
★★রসবি তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Rossby Waves)
1. ঊর্ধ্ব বায়ুতে সর্পিল প্রকৃতির এই প্রবাহ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকায় উভয় গোলার্ধেই কতকগুলি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।
2 মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলের ওপরের বায়ু স্তরে (উভয় গোলার্ধে) 3 থেকে 6টি রসবি তরঙ্গ লক্ষণীয় হয় (Trewartha, 1968)।
3. ভূপৃষ্ঠে ডিপ্রেসন বা নিম্নচাপের সৃষ্টি এবং স্থানান্তরে বা পরিভ্রমণে রসবি তরঙ্গের প্রভাব স্পষ্ট।
4. রসবি তরঙ্গগুলি কোথাও স্থায়ী আবার কোথাও অস্থায়ী প্রকৃতির হয়। উচ্চ পর্বতমালার অবস্থানজনিত কারণে এই তরঙ্গের গতিপথ কোথাও পরিবর্তিত হয়।
5. সব থেকে স্থায়ী রসবি তরঙ্গ 70° পশ্চিম ও 150° পূর্ব দ্রাঘিমার ওপর লক্ষণীয় হয়।
6. রসবি তরঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় 3000-6000 কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে (Trewartha, 1968)।
7. রসবি তরঙ্গ যেখানে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে বাঁক নেয় সেখানে জেট বায়ুর গতিবেগ অনেক বেড়ে যায়।
৪. রসবি তরঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বায়ু মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন প্রকার বলের পরিবর্তনশীল ভারসাম্য দ্বারা। এই ভারসাম্য জিওস্ট্রফিক বা উপ-জিওস্ট্রফিক বা সুপার জিওস্ট্রফিক যে-কোনো ধরনের হতে পারে।
9. রসবি তরঙ্গের গতিবেগ ‘ট্রাফ’ (Trough) বা অবতল পৃষ্ঠের তুলনায় ‘রিজ' (Ridge) বা উত্তল পৃষ্ঠে বেশি হয়ে থাকে।
7.14.4 রসবি তরঙ্গের পরিবর্তন বিন্যাস (Changing Pattern of Rossby Waves)
রসবি তরঙ্গের সংখ্যা ও অবস্থান প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়ার সমীক্ষণে এই পরিবর্তনের বিন্যাস বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তন দীর্ঘ সময়ের ভিত্তিতে এবং স্বল্প সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে থাকে। তবে স্বল্প সময়ে তরঙ্গের আকৃতি ও বিন্যাস খুবই অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়ে থাকে। পরিবর্তনের এই প্রকৃতিকে সাধারণভাবে সূচক চক্র বা ইনডেক্স সাইকেল (Index cycle) দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। চক্র অনুযায়ী পরিবর্তনের ধরন হল (Trewartha, 1968)--------
1. সক্রিয় বা তীব্র গতিসম্পন্ন পশ্চিমাবায়ুর সঙ্গে দুর্বল প্রকৃতির তরঙ্গ গড়ে ওঠে। এর ফলে ঊর্ধ্ব পশ্চিমাবায়ুতে একটি শক্তিশালী বায়ুচাপ ঢাল (strong pressure gradient) সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় উচ্চ বলয়াকার সূচক (High Zonal Index)।
2. বায়ু দ্রাঘিমারেখা বরাবর প্রবাহিত হয়; যাকে বলা হয় দ্রাঘিমাগত প্রবাহ (Meridional flow)। অক্ষাংশ বরাবর বায়ুচাপের পার্থক্য বা ব্যবধান হ্রাস পায়। এই অবস্থাকে বলা হয় নিম্ন বলয়াকার সূচক (Low Zonal Index) |
3. ঘটনাক্রমে তরঙ্গ ভাঙতে থাকে। তরঙ্গ বক্রতা খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে কয়েকটি কোশীয় গঠন বা কোশীয় বিন্যাস (Cellular pattern) তৈরি হয়। বায়ুপুঞ্জ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ঘূর্ণবায়ু (Cyclonic) এবং প্রতীপ ঘূর্ণবায়ুর (Anticyclonic) জন্ম হয়। এইরকম বিচ্ছিন্ন নিম্নচাপ ও উচ্চচাপ কোশ পশ্চিম থেকে পূর্বে বায়ুর স্বাভাবিক প্রবাহকে অবরুদ্ধ করে দেয়। এই অবরুদ্ধ বা আটকে দেওয়ার বিষয়টি অবরুদ্ধ তন্ত্র বা ব্লকিং সিস্টেম (Blocking system) নামে পরিচিত।
Comments
Post a Comment